এখন ভীষণ গরম। আর পাল্লা দিয়ে বেড়েই চলেছে লোডশেডিং, রোদের তীব্রতা। রোদ ও ধুলাবালিতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে আমাদের ত্বক। যাঁরা চাকরিজীবী বা প্রয়োজনে দীর্ঘ সময় রোদে থাকেন, ত্বকের প্রতি অতিরিক্ত উদাসীন, তাঁরাই ক্ষতির শিকার হন বেশি। রোদে রয়েছে ভিটামিন-ডি, যা ত্বকের পুষ্টি জোগায়। কিন্তু দীর্ঘ সময় ধরে রোদে পোড়াটাও ত্বকের জন্য ক্ষতিকর। রোদের ক্ষতিকর আল্ট্রা ভায়োলেট রশ্মি ত্বকের ঔজ্জ্বল্য নষ্ট করে। তাই এ ঋতুতে ঘাম, ধুলাবালি, আল্ট্রা ভায়োলেট রশ্মি থেকে ত্বককে রক্ষা করা অপরিহার্য।গরমে যত্নের অভাবে ত্বকে নানা ধরনের সমস্যা তৈরি হয়। অনেক সময় ত্বকের দাগ স্থায়ী হয়ে ওঠে, যা দেখতে দৃষ্টিকটু। এ অবস্থা থেকে মুক্তির জন্য প্রয়োজন আপনার অভ্যাসের পরিবর্তন। নিজেকে বদলে ফেলুন। ত্বকের প্রতি দৃষ্টি দিন। সামান্য কিছু সতর্কতা আপনার ত্বককে করবে আরও বেশি আকর্ষণীয়।
হিট সিনকোপ
আমাদের ত্বকে রয়েছে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ছিদ্র আর ঘাম ও তেলগ্রন্থি। এই গ্রন্থিগুলো ঘাম, তেল, অপ্রয়োজনীয় পদার্থ ঘাম আকারে দেহ থেকে বের করে দেয়। রোদ ও গরম বেশি হলে এই গ্রন্থি ও ছিদ্র দিয়ে দূষিত পদার্থের সঙ্গে প্রয়োজনীয় লবণ, পানি দেহের বাইরে চলে যায়। পরিণামে প্রতিটি অঙ্গে রক্ত চলাচলে ব্যাঘাত ঘটে। ফলে ক্ষতিকর প্রভাবের শিকার হয় ত্বক ও চুল। ত্বকের আর্দ্রতা কমে যাওয়ায় ত্বকে ভাঁজ পড়ে যায়। ত্বকের গোড়ায় অসংখ্য লোমকূপ থাকে। আর্দ্রতার অভাবে লোমকূপগুলোয় ধুলাবালি জমে। সঠিকভাবে ঘাম, তেল নিঃসরণ হতে পারে না। ফলে লোমকূপের গোড়ায় রোগজীবাণু বাসা বাঁধে। লোমকূপের ছিদ্র বন্ধ হয়ে অক্সিজেন ঢুকতে পারে না। এতে ত্বকে ঘামাচির মতো কালচে, পোড়া, তামাটে বর্ণের বৃত্তে ভরে ওঠে। ত্বকের বিভিন্ন স্থানে ঝলসে যাওয়ার মতো হয়। এ পরিস্থিতিকে বলে হিট সিনকোপ।
যাঁদের ত্বক বাংলাদেশের আবহাওয়ায় বেশি ফরসা এবং রোদে পোড়েন বেশি, তাঁদের হিট সিনকোপ হওয়ার আশঙ্কা বেশি।হিট সিনকোপ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য করণীয়-
১. প্রচুর পরিমাণে পানি, টাটকা শাকসবজি, মৌসুমি ফল খান।
২. ত্বকের যেকোনো সমস্যায় নখ দিয়ে চুলকাবেন না। পাতলা কাপড় বা তুলা দিয়ে চুলকাতে পারেন।
৩. ত্বক ও প্রায় প্রতিটি অঙ্গের জন্য তিতা খাবার (করলা, চিরতার রস) খুব উপকারী।
৪. রোদে বের হওয়ার আগে অবশ্যই ছাতা ও সানস্ক্রিন ক্রিম ব্যবহার করবেন।
৫. নিয়মিত গোসল ও ঘুম জরুরি।
৬. দিনের বেলা বের না হয়ে সম্ভব হলে প্রয়োজনীয় কাজগুলো রাতে বা সন্ধ্যায় সেরে ফেলুন।
৭. বাইরে থেকে এসেই স্বাভাবিক পানিতে মুখ ধুয়ে ফেলুন। তারপর ফেসওয়াশ ব্যবহার করুন। সম্ভব হলে বারবার স্বাভাবিক পানিতে মুখ ধুয়ে ফেলুন। এতে ত্বকের ধুলাবালি, তেল, রোগজীবাণু পরিষ্কার হয়ে যাবে।
৮. মেকআপ, ঘাম মিশে যেন তৈলাক্ত অবস্থার সৃষ্টি না করে সেদিকে দৃষ্টি দিন।
৯. আরামদায়ক, ঢিলেঢালা, সাদা বা অন্য হালকা রঙের পোশাক পরুন। কালো পোশাকে রোদে গরম লাগবে বেশি। এতে দেহের অভ্যন্তরীণ তাপমাত্রা বেড়ে চেহারা বাজে দেখাবে। ফলে অল্প তাপেই হিট সিনকোপ হবে বেশি।
হিট ক্র্যাম্প
হিট ক্র্যাম্পে রোদের তাপ ও গরমে মুখের ত্বকের মাংসপেশির মাত্রাতিরিক্ত সংকোচন হয়। ত্বক দেখতে মনে হয় কুঁচকানো। পরিণামে ত্বকে কালো দাগ দেখা যায়। এই দাগ যত্নের অভাবে স্থায়ী দাগে পরিণত হয়। যাঁরা দীর্ঘ সময় রোদে পোড়েন বা রান্না করেন, তাপে তাঁদের হিট ক্র্যাম্প হয় বেশি। ত্বকের মাংসপেশি অতিরিক্ত পানিশূন্য হয়ে হিট ক্র্যাম্প তৈরি করে।
হিট ক্র্যাম্পে ত্বক খসখসে হয়ে মসৃণতা হারায়। ফলে অকালেই বার্ধক্য চলে আসে। কপাল, চোখের নিচে, নাকের দুই পাশের ত্বক কুঁচকে যায়। এ অবস্থা এড়াতে-
১. যাঁরা অতিরিক্ত ঘামেন, তাঁরা সপ্তাহে অন্তত দুই দিন খাওয়ার স্যালাইন খান। খাওয়ার স্যালাইন দেহ থেকে বের হয়ে যাওয়া লবণ ও পানির ক্ষয় পূরণ করে। যাঁদের উচ্চ রক্তচাপ এবং হাত-পায়ের আঙুল ফুলে যাওয়ার সমস্যা রয়েছে, তাঁরা চিকিৎসকের পরামর্শ ব্যতীত বাড়তি লবণ খাবেন না।
২. রান্নাঘরের ধোঁয়া ও তাপ বের হয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা থাকা প্রয়োজন। রান্নার সময় প্রয়োজনে ছোট হাতপাখা রাখতে পারেন। কাজের ফাঁকে পাখার বাতাসে মুখের ঘাম শুকাবে, আর শরীরের তাপমাত্রাও বাড়বে না। সম্ভব হলে পাতলা পোশাকে রান্নাঘরে যান। রান্নার কোনো এক ফাঁকে কলের পানিতে মুখ ধুয়ে নিন। এতে মুখের ত্বকের ময়লা পরিষ্কার হবে। গরমও তুলনামূলকভাবে কম লাগবে।
৩. প্রতিটি ঘরে পর্যাপ্ত পরিমাণে আলো-বাতাসের ব্যবস্থা থাকা উচিত।
৪. সম্ভব হলে সকালে গোসল করুন। ভোরের মুক্ত বাতাসে হাঁটার কোনো বিকল্প নেই। প্রায় সব বয়সের মানুষের জন্য হাঁটা প্রয়োজন। এতে দেহের প্রতিটি অঙ্গসহ ত্বকও শক্তিশালী হবে। হাঁটার সময় ত্বকের দূষিত পদার্থগুলো ঘাম হয়ে বের হয়ে যায়। ফলে ত্বকের লোমকূপের গোড়া পরিষ্কার হয়। ত্বকের লোমকূপ দিয়ে অক্সিজেন প্রবেশ করে বেশি। এতে ত্বক হিট ক্র্যাম্প থেকে নিজেকে রক্ষা করতে শেখে।
৫. নিয়মিত ফলের রস খান। তবে যাঁদের ডায়াবেটিস ও উচ্চ কোলস্টেরল রয়েছে তাঁদের মিষ্টি ফল বাদ দেওয়াই ভালো। টক ফল বেশি করে খান।
৬. নিয়মিত ত্বক পরিষ্কার রাখুন। ত্বকের আর্দ্রতা বৃদ্ধির জন্য গ্রীকালীন ফল তরমুজের রস খুব উপকারী। তরমুজের রস দিয়ে মুখ পরিষ্কার করলে ত্বকের আর্দ্র ও ঔজ্জ্বলতা বৃদ্ধি পায়।
৭. ত্বকের যেকোনো সমস্যার জন্য প্রতিষ্ঠিত কোম্পানির উপটান বা চন্দনের গুঁড়া ব্যবহার করুন।
সামার বয়েল
ব্রণ হালকা লালচে হয়ে ফুলে যায়। আর সামার বয়েলে গোল দানার মধ্যে পুঁজ জমে যায়। দানাটির গোড়া ত্বকের রঙের মতোই থাকে। উপরিভাগে পুঁজ জমে যাওয়ার জন্য সাদা বর্ণ ধারণ করে। লোমকূপের গোড়ায় সংক্রমণ হলে বা নখের আঘাতে সামার বয়েল তৈরি হয়। সামার বয়েলে চুলকানি ও হালকা ব্যথা থাকে।
১. সামার বয়েল নখ দিয়ে খুঁটবেন না বা পুঁজ কোনো কিছু দিয়ে বের করবেন না।
২. সামার বয়েলে সাবান বা ফেসওয়াশ ব্যবহারে অনেকেরই মুখ জ্বলে। অথচ এমন অবস্থায় নিয়মিত মুখ পরিষ্কার রাখা প্রয়োজন। ময়দা, বেসন বা মসুর ডাল বাটা, উপটান দিয়ে মুখ পরিষ্কার করুন। মুখের ত্বকে ঘষাঘষি করবেন না।
৩. লোমকূপের গোড়ায় অণুজীবের (ব্যাকটেরিয়া, ছত্রাক) আক্রমণে সামার বয়েল হয়। সামার বয়েল হলে সপ্তাহে অন্তত এক দিন গোসলের বালতিতে কয়েক ফোঁটা ডেটল বা স্যাভলন মিশিয়ে গোসল করুন। এতে ত্বকের রোগজীবাণু মারা যাবে।
৪. যত দূর সম্ভব ভারী মেকআপ এড়িয়ে চলুন। পুরুষেরা এ সময় খেয়াল রাখবেন, শেভ করার সময় যেন সামার বয়েল ফেটে না যায়।
৫. নিমপাতা বেটে মুখে লাগাতে পারেন। যাঁদের নিমপাতা দিলে ত্বকে চুলকায়, তাঁরা লাগাবেন না।
৬. কোষ্ঠকাঠিন্য থাকলে অনেকেরই বয়েল বা ব্রণ হয়। কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করার জন্য আঁশজাতীয় খাবার (পুঁইশাকের ডাঁটা, ঢ্যাঁড়স, কচুর লতি) খান। প্রতিদিন সকালে ইসবগুলের ভুসি হালকা গরম পানিতে ভিজিয়ে খালি পেটে দাঁত ব্রাশের পরে খান।
৭. অতিরিক্ত কড়া লিকারের চা বা কফি খাবেন না। ত্বক ও দেহের প্রতিটি অঙ্গের জন্য মাদক, ধূমপান, মাত্রাতিরিক্ত স্মেহজাতীয় খাবার (মাখন, মেয়নিজ, পনির, ডিমের কুসুম, চিনি) পরিহার করা জরুরি।
পিমপল বা ব্রণ
ব্রণ প্রায় সব রকম ত্বকের এবং সব ঋতুরই সমস্যা। কৈশোরের শেষের দিকে প্রায় সবারই ব্রণ হয়। ব্রণ হওয়ার জন্য অনেক কারণ দায়ী যেমন-
১. অতিরিক্ত দুশ্চিন্তা, রাত জাগা, ত্বকের যত্ন না করা, দীর্ঘ সময় পর্যন্ত অভুক্ত থাকা।
২. হঠাৎ করে অতিরিক্ত খাবার নিয়ন্ত্রণ।
৩. অতিরিক্ত তৈলাক্ত খাবার গ্রহণ।
৪. রোদ, ধুলাবালিতে অধিক সময় অবস্থান।
ব্রণ থেকে মুক্তির জন্য
১. ত্বক নিয়মিত পরিষ্কার রাখতে হবে।
২. দুধ চায়ের পরিবর্তে আদা চা বা সবুজ চা স্বাস্থ্য ও ত্বকের জন্য উপকারী।
৩. প্রচুর পরিমাণে কাঁচা সবজির সালাদ খান।
৪. মেকআপ ভালোভাবে ফেসওয়াশ দিয়ে তুলে ফেলুন।
৫. তৈলাক্ত ত্বকে ব্রণ হয় বেশি। তাই তৈলাক্ত ত্বকের অধিকারীরা নিয়মিত যত্ন নিন।
৬. তেলে ভাজা খাবার যতটা সম্ভব এড়িয়ে চলুন।
৭. ফেসিয়াল করাতে চাইলে যতটা সম্ভব প্রাকৃতিক উপাদান দিয়ে করান।
৮. ভালোভাবে না জেনে অপরিচিত কোম্পানির পণ্য ব্যবহার করবেন না।
৯. সঠিক সময়ে ঘুম এবং খাদ্যাভ্যাস গড়ে তুলুন। বয়স ও উচ্চতা অনুযায়ী দেহের ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখুন।