থ্যালাসেমিয়া

শেয়ার করুন

সুচিপত্র

থ্যালাসেমিয়া একটি বংশগত রক্ত রোগ। রক্তে হিমোগ্লোবিনের পরিমাণ কম হলে থ্যালাসেমিয়া দেখা দেয়। থ্যালাসেমিয়া থেকে মারাত্মক রক্ত শূণ্যতা দেখা দিতে পারে।

থ্যালাসেমিয়া কি

থ্যালাসেমিয়া হলো বংশানুক্রমে পাওয়া রক্তের একটি সমস্যা বা রোগ। রক্তে যদি স্বাভাবিক হিমোগ্লোবিন কম থাকে তাহলে থ্যালসেমিয়া হয়। এর ফলে রক্তশুণ্যতাও দেখা দিতে পারে। থ্যালাসেমিয়া গুরুতর না হলে চিকিৎসার তেমন প্রয়োজন নেই। তবে থ্যালাসেমিয়া মারাত্মক আকার ধারণ করলে রুগীর শরীরে নিয়মিত রক্ত দিতে হয়।

থ্যালাসেমিয়া হয়েছে কি করে বুঝবেন

থ্যালাসেমিয়ার ধরণ এবং এর তীব্রতার উপর নির্ভর করে এর উপসর্গগুলো ভিন্ন হয়ে থাকে।

থ্যালাসেমিয়া হলে সাধারণত: যেসব লক্ষণ ও উপসর্গগুলো দেখা যায়:

  • অবসাদ অনুভব
  • দূর্বলতা
  • শ্বাসকষ্ট
  • মুখ-মন্ডল ফ্যাকাশে হয়ে যাওয়া
  • অস্বস্তি
  • ত্বক হলদে হয়ে যাওয়া (জন্ডিস)
  • মুখের হাড়ের বিকৃতি
  • ধীরগতিতে শারীরিক বৃদ্ধি
  • পেট বাইরের দিকে প্রসারিত হওয়া বা বৃদ্ধি পাওয়া
  • গাঢ় রঙের প্রস্রাব

কখন ডাক্তার দেখাবেন

উপরোক্ত লক্ষণ ও উপসর্গ দেখা দেয়ার সাথে সাথে ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ করতে হবে।

কি ধরণের পরীক্ষা-নিরীক্ষার প্রয়োজন হতে পারে

  • রক্ত পরীক্ষা
  • গর্ভাবস্থায়  পরীক্ষা

কি ধরণের চিকিৎসা আছে

রোগের মাত্রা ও ধরণের উপর  থ্যালাসেমিয়ার চিকিৎসা নির্ভর করে।

মৃদু থ্যালাসেমিয়ার ক্ষেত্রে

  • মৃদু থ্যালাসেমিয়ার লক্ষণ ও উপসর্গ খুবই কম থাকে এবং এক্ষেত্রে খুবই অল্প চিকিৎসার প্রয়োজন হয়।
  • বিশেষ ক্ষেত্রে যেমন-কোন অপারেশন হলে বা প্রসবের পর অথবা কোন সংক্রমণ হলে প্রয়োজন বোধে রক্ত দেয়া (Blood transfusion) লাগতে পারে।

মাঝারি থেকে মারাত্মক থ্যালাসেমিয়ার ক্ষেত্রে

  • বছরে বেশ কয়েকবার প্রয়োজনবোধে ৮ থেকে ১০ বার রক্ত দেয়া লাগতে পারে
  • কিছু কিছু ক্ষেত্রে অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপন (Bone Marrow transplant) করার প্রয়োজন হতে পারে
  • ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী ঔষধ ( আয়রণ ও ফলিক এসিড) ও পথ্য সেবন করা

জীবন-যাপন পদ্ধতি

  • ডাক্তারের নির্দেশনা ছাড়া আয়রণযুক্ত ঔষধ, ভিটামিন বা অন্যকোন ঔষধ খাওয়া যাবে না
  • সুষম ও পুষ্টিকর খাবার বিশেষ করে ক্যালসিয়াম, জিংক, ভিটামিন ডি সমৃদ্ধ খাবার খেতে হবে
  • সংক্রমণ এড়াবার জন্য বারবার হাত ধুতে হবে এবং অসুস্থ ব্যক্তিদের থেকে দূরে থাকতে হবে
  • এছাড়া সংক্রমণ এড়াবার জন্য  টিকা নিতে হবে

প্রতিরোধ

  • যদি আপনার, আপনার পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের, স্ত্রীর ও স্ত্রীর পরিবারের সদস্যদের কারো থ্যালাসেমিয়া রোগের ইতিহাস থাকে তাহলে অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে।
  • গর্ভধারণ করার আগে ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে।

থ্যালাসেমিয়া কেন হয় ?

ত্রুটিপূর্ণ হিমোগ্লোবিন জিনের কারণে থ্যালাসেমিয়া হয়। বাবা অথবা মা, অথবা বাবা- মা উভয়েরই থ্যালাসেমিয়া জীন থাকলে বংশানুক্রমে এটি সন্তানের মধ্যে  ছড়ায়।

থ্যালাসেমিয়া কয় ধরণের হয়ে থাকে?

থ্যালসেমিয়া প্রধানত দুই ধরণের হয়। যথা :

১. আলফা থ্যালাসেমিয়া (Alpha-thalassemia) :

চারটি জিন দিয়ে আলফা থ্যালাসেমিয়া ধারা (Chain) গঠিত হয়। আমরা বাবা-মা প্রত্যেকের কাছ থেকে দুটি করে এই জিন পাই। এই জিনগুলোর মধ্যে এক বা তার অধিক ত্রুটিপূর্ণ হলে Alpha-thalassemia হয়। যত বেশি জিন ত্রুটিপূর্ণ হবে তত বেশি মারাত্মক সমস্যা দেখা দিবে। যেমন:

  • একটি জিন ত্রুটিপূর্ণ হলে থ্যালাসেমিয়ার কোন লক্ষণ ও উপসর্গ দেখা যাবে না। তবে আক্রান্ত ব্যক্তির মাধ্যমে তার সন্তানের মধ্যে এই রোগ ছড়াবে।
  • দুইটি জিন ত্রুটিপূর্ণ হলে হালকা উপসর্গ দেখা যাবে। এই অবস্থাকে বলে আলফা থ্যালাসেমিয়া মাইনর (Alpha-thalassemia minor) অথবা আলফা থ্যালাসেমিয়া ট্রেইট ( Alpha-thalassemia trait).
  • তিনটি জিন ত্রুটিপূর্ণ হলে এর উপসর্গগুলো মাঝারি থেকে মারাত্মক আকার ধারণ করে। এই অবস্থাকে বলে হিমোগ্লোবিন এইচ ডিজিজ।
  • চারটি জিন ত্রুটিপূর্ণ হলে একে বলে আলফা থ্যালাসেমিয়া মেজর (Alpha thalassemia major) অথবা হাইড্রপস ফিটেইলস (Hydrops fetalis)। এর ফলে প্রসবের (delivery) পূর্বে অথবা জিনের পরপর ভ্রূণ নষ্ট হয়ে যায়।

২. বিটা থ্যালাসেমিয়া (Beta-thalassemia) :

Beta-thalassemia ধারা গঠিত (Chain) হয় দুইটি জিন দিয়ে। বাবা-মা প্রত্যেকের কাছ থেকে একটি করে মোট দুইটি জিন আমরা পেয়ে থাকি। একটি অথবা উভয় জিনই ত্রুটিপূর্ণ হলে Beta-thalassemia দেখা দেয়।  এক্ষেত্রে:

  • একটি জিন ত্রুটিপূর্ণ হলে হালকা উপসর্গ দেখা যায়। এই অবস্থাকে বলে বিটা থ্যালাসেমিয়া মেজর (Beta-thalassemia major) অথবা বিটা থ্যালাসেমিয়া ট্রেইট (Beta-thalassemia trait).
  • দুইটি জিনই ত্রুটিপূর্ণ হলে মাঝারি থেকে মারাত্মক উপসর্গ দেখা যায়। এ অবস্থাকে বলে বিটা থ্যালাসেমিয়া মেজর ( Beta-thalassemia major) অথবা কুলিস এ্যানিমিয়া (Cooley’s anemia)। নবজাতক যেসব শিশুর এই সমস্যা থাকে তারা জন্মের সময় বেশ স্বাস্থ্যবান থাকে। তবে জন্মের প্রথম দুই বছরের মধ্যেই এর উপসর্গ দেখা যায়।

হিমোগ্লোবিন কি?

হিমোগ্লোবিন লাল রংয়ের এবং প্রোটিন সমৃদ্ধ একটি উপাদান যা লোহিত রক্ত কণিকায় বিদ্যামান থাকে। হিমোগ্লোবিন লোহিত রক্ত কণিকাকে ফুসফুস থেকে শরীরের সব অংশে অক্সিজেন সরবরাহে এবং শরীরের অন্যান্য অংশ থেকে ফুসফুসে কার্বন-ডাই- অক্সাইড সরবরাহে সাহায্য করে।

কাদের থ্যালাসেমিয়া হওয়ার ঝুঁকি বেশি রয়েছে ?

যাদের থ্যালাসেমিয়া হওয়ার ঝুঁকি বেশি রয়েছে তারা হলেন :

  • বাবা মায়ের থ্যালাসেমিয়া থাকলে তাদের সন্তানদের মধ্যেও এই রোগ দেখা দেয়।
  • কিছু কিছু জাতির মধ্যে যেমন-দক্ষিণ এশিয়া, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, আফ্রিকা, ইটালী, গ্রীক, মধ্যপ্রাচ্যের মানুষদের মধ্যে থ্যালাসেমিয়া রোগটি বেশী দেখা যায়।

থ্যালাসেমিয়ার ফলে কি ধরণের জটিলতা দেখা দিতে পারে?

থ্যালাসেমিয়ার ফলে নিচের জটিলতাগুলো দেখা দিতে পারে :

  • রক্ত পরিবর্তন অথবা রোগের কারণে রক্তে আয়রণের পরিমাণ বেড়ে যায়। রক্তে আয়রনের পরিমাণ বেড়ে গেলে তা হৃৎপিন্ড, যকৃত এবং এন্ডোক্রাইন ব্যবস্থা কে (Endocrine system) ক্ষতিগ্রস্থ  করে।
  • রক্ত পরিবর্তনের কারণে রক্ত বাহিত বিভিন্ন রোগ যেমন-হেপাটাইটিসের সংক্রমণ হয়।
  • অস্থিমজ্জা প্রসারিত হয়ে যায় এবং এর ফলে হাড় পাতলা ও ভঙ্গুর হয়ে যায়। এতে মেরুদন্ডের হাড় ভেঙ্গে যাবার সম্ভাবনা বেশি থাকে।
  • থ্যালাসেমিয়া লোহিত রক্তক্ষণিকা ধ্বংস করে প্লীহার (Spleen) কার্যকারিতার উপর চাপ ফেলে এবং প্লীহা বড় হয়ে যায় (Spleen Enlargement)।

রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে কোন বিষয় গুলো জানা যায়?

রক্তের পরীক্ষার মাধ্যেমে যে বিষয়গুলো জানা যায়:

  • লোহিত রক্তকণিকা কমমাত্রায় (Low level) থাকা
  • লোহিত রক্ত কণিকার পরিমাণ কম থাকা
  • লোহিত রক্ত কণিকার আকার পরিবর্তিত হওয়া
  • বিবর্ণ (Pale) লোহিত রক্ত কণিকা
  • লোহিত রক্ত কণিকায় হিমোগ্লোবিনের অসম থাকা যা মাইক্রোস্কোপে ষাড়ের চোখের মত দেখা যায়

এছাড়া রক্তের পরীক্ষার মাধ্যমে নিচের বিষয়গুলোও জানা যায় :

  • শিশুর রক্তে আয়রণ/লৌহের পরিমাণ
  • হিমোগ্লোবিনের পরিমাণ
  • ডিএনএ বিশ্লেষণের মাধ্যমে থ্যালাসেমিয়া আছে কিনা অথবা রুগী ত্রটিপূর্ণ হিমোগ্লোবিন জিন বহন করছে কিন

গর্ভস্থ সন্তানের থ্যালাসেমিয়া আছে কিনা তা জানার জন্য কোন পরীক্ষাগুলো করা হয়?

এক্ষেত্রে যে পরীক্ষা গুলো করা হয় সেগুলো হলো:

  • কোরিওনিক ভিলিয়াস স্যাম্পলিং (Chorionic villus sampling)
  • এ্যামনিওসেনটিসিস (Amniocentesis)
  • ফিটাল ব্লাড স্যাম্পলিং (Fetal blood sampling)