দূর্যোগের সময় প্রাথমিক চিকিৎসা
হাসপাতালে নেয়ার আগে অথবা উপযুক্ত চিকিৎসক ( ডাক্তার বা নার্স) আসার পূর্বে দূর্ঘটনায় আঘাতপ্রাপ্ত, আহত বা হঠাৎ অসুস্থ কোন ব্যক্তিকে জরুরী ভিত্তিতে যে সেবা-শুশ্রূষা প্রদান করা হয় তাকেই প্রাথমিক চিকিৎসক বলা হয়। বাংলাদেশে প্রাকৃতিক দূর্যোগ প্রবন এলাকাগুলোর স্থানীয় জনগনের অবশ্যই প্রাথমিক চিকিৎসার জ্ঞান থাকা উচিত। কারণ, যে কোন দূর্যোগের পর পর যদি আঘাতপ্রাপ্ত অথবা মৃত্যূ পথযাত্রী মানুষকে দক্ষতার সাথে তাৎক্ষনিক সেবা-শুশ্রূষা বা প্রাথমিক চিকিৎসা প্রদান করা যায় তবে একদিকে যেমন প্রাণহানীর ঘটনা কমিয়ে আনা যাবে অন্যদিকে তা পরোক্ষভাবে দূর্যোগ পরবর্তী সময়ে জনস্বাস্থ্য সমস্যা বহুলাংশে কমিয়ে আনা সম্ভব।
প্রাথমিক চিকিৎসার উদ্দেশ্য
প্রাথমিক চিকিৎসার উদ্দেশ্য মূলতঃ তিনটি। যথাঃ-
- রোগীর জীবন রক্ষায় সাহায্য করা
- রোগীর অবস্থার অবনতি রোধ করা এবং
- রোগীর অবস্থার উন্নতি করা
প্রাথমিক চিকিৎসাকারীর দায়িত্ব ও কর্তব্য
- নিজেকে ঝুঁকিমুক্ত রেখে পরিস্থিতির মূল্যায়ন করতে হবে
- রোগীর সঠিক রোগ বা অসুবিধা নির্ণয় করতে হবে
- দ্রুত চিকিৎসা দিতে হবে। খেয়াল রাখতে হবে যে রোগীর একাধিক জখম থাকতে পারে
- দ্রুত ডাক্তার বা হাসপাতালে প্রেরণের ব্যবস্থা করতে হবে
ব্যবস্থাপনা
প্রাথমিক চিকিৎসাকারীকে অবশ্যই জানতে হবে যে দূর্যোগের আগে কি ধরণের প্রস্ত্ততিমূলক ব্যবস্থা নেয়া উচিত, দূর্যোগ চলাকালীন কি ভূমিকা পালন করা দরকার এবং দূর্যোগ পরবর্তী সময়ে তার দায়িত্ব কি হবে।
দূর্যোগের আগে
- প্রাথমিক চিকিৎসাকারী হিসেবে এলাকার জনসাধারণের কাছে পরিচিত হতে হবে যাতে দূর্যোগ চলাকালীন ও দূর্যোগ পরবর্তী সময়ে চিকিৎসাগ্রহনকারী ব্যক্তি তাকে সহজেই চিনতে পারে ।
- দূর্যোগের সময় সম্ভাব্য শারীরিক ক্ষতি সম্পর্কে এলাকার জনসাধারণকে অবহিত করতে হবে
- নিকটস্থ হাসপাতাল স্বাস্থ্যকেন্দ্রে ও ডাক্তারের অবস্থান সম্পর্কে জানতে হবে। কারণ, দূর্যোগের পর মারাত্মক আহত রোগীদের সেখানে প্রেরণ করতে হবে।
- দূর্যোগের পর রাস্তা ঘাট অনেক ক্ষেত্রেই বন্ধ হয়ে যায়। হাসপাতাল বা স্বাস্থ্য কেন্দ্রে যাওয়ার বিকল্প পথ সম্পর্কে ধারণা থাকতে হবে।
- প্রয়োজনের সময় ব্যবহার করার জন্য প্রাথমিক চিকিৎসার সরঞ্জাম যথাযথ ভাবে মজুদ ও সংরক্ষণ করতে হবে।
- সর্বোপরি প্রাথমিক চিকিৎসার প্রশিক্ষণলব্ধ জ্ঞানের চর্চা রাখতে হবে।
দূর্যোগের পরে
- দ্রুত প্রাথমিক চিকিৎসা কেন্দ্র স্থাপন করতে হবে। তাঁবু, স্কুল, ঘর বাড়ীতে অথবা অন্য কোন উপযুক্ত স্থানে এই কেন্দ্র স্থাপন করা যেতে পারে ।
- দ্রুত সম্ভব নিকটস্থ হাসপাতাল বা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ করাপ্রাথমিক চিকিৎসা কেন্দ্রে সার্বক্ষনিক ভাবে উপযুক্ত প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত এবং অপেক্ষাকৃত দক্ষ প্রাথমিক চিকিৎসাকারীদের নিয়োগ করতে হবে এবং একই সঙ্গে প্রাথমিক চিকিৎসার হাত-ব্যাগসহ ভ্রাম্যমাণ কর্মী দলকে কাজে লাগাতে হবে।
- যত দ্রুত সম্ভব নিকটস্থ হাসপাতাল বা স্বাস্থ্যকেন্দ্রের ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ করতে হবে।
- হাসপাতাল বা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে রোগী স্থানান্তর করার জন্য স্থানীয় ভাবে এ্যাম্বুলেন্স প্রস্ত্তত রাখতে হবে। গরুর গাড়ী, রিক্সা, ঠেলাগাড়ী, ভ্যান ইত্যাদি বাহনকে এ্যাম্বুলেন্স হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে। প্রয়োজনে রোগীকে দ্রুত হাসপাতালে স্থানান্তর করতে হবে।
পর্যবেক্ষণ
প্রাথমিক পর্যবেক্ষণ
দূর্ঘটনা কবলিত আহত ব্যক্তির কাছে পৌছে তার অবস্থা পর্যবেক্ষণ করতে হবে । ক্রমান্বয়ে যে সব বিষয়ের দিকে বিশেষ দৃষ্টি দিতে হবে সেগুলি হলো —
- আহত ব্যক্তির শ্বাসনালী খোলা আছে কি না দেখতে হবে। শ্বাস প্রশ্বাসে অসুবিধা হলে রোগীর মাথা পেছনে দিক কাত করে দিতে হবে। এতে শ্বাসনালীর মুখ খুলে যায় এবং শ্বাস প্রশ্বাসে সুবিধা হয়।
- শ্বাস প্রশ্বাস বন্ধ আছে কিনা দেখতে হবে। যদি শ্বাস প্রশ্বাস বন্ধ হয়ে যায় তাহলে কৃত্রিম উপায়ে শ্বাস-প্রশ্বাস এর ব্যবস্থা করতে হবে।
- মাথায় মারাত্মক আঘাত পেয়েছে কিনা দেখতে হবে। আঘাতপ্রাপ্ত হলে দ্রুত ডাক্তারের কাছে পাঠাতে হবে।
- প্রচুর রক্তপাত বা রক্তক্ষরণ হচ্ছে কিনা দেখতে হবে। প্রচুর রক্তপাত বা রক্তক্ষরণ হলে অবশ্যই দ্রুত তা বন্ধ করার ব্যবস্থা করতে হবে।
- আহত ব্যাক্তি অজ্ঞান হয়ে আছে কিনা দেখতে হবে। অজ্ঞান রোগীর দ্রুত জ্ঞান ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করতে হবে।
পরবর্তী পর্যবেক্ষণ
প্রাথমিক পর্যবেক্ষণের পর দেখা দরকার আহত বা অসুস্থ ব্যক্তিটির-
- পেট পানি ভর্তি আছে কিনা
- মারাত্মক ভাবে পুড়ে গেছে কি না
- সাপে কেটেছে কি না
- অন্যান্য আঘাত আছে কি না
প্রাথমিক চিকিৎসার ক্ষেত্রে আবশ্যিক কিছু বিষয়
- শ্বাস-প্রশ্বাসের পথ খোলা রাখতে হবে।
- কৃত্রিম শ্বাসের ব্যবস্থা নিতে হবে ।
- রক্তপাত বা রক্তক্ষরণ বন্ধ করুণ এবং রক্ত চলাচলের ব্যবস্থা রাখতে হবে ।
- মাথা ঠান্ডা রেখে দ্রুত কাজ করতে হবে।
- প্রাথমিক চিকিৎসাকারী ডাক্তার নন।
- বিলম্বিত সাহায্য, সাহায্য না করারই সমান।
- নিশ্চিত না হয়ে কোন কিছু করা ঠিক হবে না।
প্রাথমিক চিকিৎসাঃ সামগ্রী ও উপকরণ
মনে রাখতে হবে যিনি প্রাথমিক চিকিৎসা দেন তিনি সাধারণতঃ ডাক্তার নন। তাঁর কাজ হচ্ছে অসুস্থ্য ব্যক্তিকে উপযুক্ত চিকিৎসকের কাছে পাঠিয়ে দিতে হবে। তবুও হাতের কাছে কিছু সামগ্রী থাকা প্রয়োজন। অনেক সময় উপযুক্ত চিকিৎসক দূর্যোগগ্রস্ত এলাকায় প্রায় খালি হাতে এসে পড়েন। এসব ক্ষেত্রে প্রাথমিক উপকরণগুলো অনেক কাজে আসে। এখানে কিছু উপকরনের তালিকা দেয়া হলো। তালিকা প্রয়োজন অনুযায়ী সংযোজন ও সংশোধন করে নিতে হবে।
- থার্মোমিটার
- ডিসপেনসারী ফোরসেপ
- তুলা
- এন্টিসেপটিক/ এন্টিবায়োটিক পাউডার
- তরল এন্টিসেপটিক (স্যাভলন)
- প্যারাসিটামল ট্যাবলেট
- লিকো প্লাষ্ট
- সার্জিকেল নিডল(সুঁচ)
- ক্ষত সেলাইয়ের সুতা
- সেফটি পিন
- ১০-১৫ এ্যাডহেসিভ ড্রেসিং
- আর্টারী ফোরসেপ
- রোল ব্যান্ডেজ
- সার্জিকেল গজ
- বারনল ক্রীম
- এন্টিসেপটিক ক্রীম (স্যাভলন ক্রীম)
- ডিসপোজেবল সিরিঞ্জ
- বাটার ফ্লাই নিডল
- কাঁচি
- ব্লেড
- জীবানুমুক্ত চোখের প্যাড