শীতে বাতের ব্যথা

শেয়ার করুন

সুচিপত্র

বার্ধক্যজনিত বাতের ব্যথায় আক্রান্ত হন প্রচুর মানুষ। এই রোগটি অল্পবয়সী মানুষের মধ্যেও দেখা যাচ্ছে। শীতকালে কায়িক শ্রম কমে যাওয়ায় রোগটির তীব্রতা বাড়ে। অথচ একটু সচেতন হলে ভালো থাকা যায়। পরামর্শ দিয়েছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) রিউমাটোলজি বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. মিনহাজ রহিম চৌধুরী

বিভিন্ন রোগের আক্রমণ থেকে বাঁচাতে আমাদের দেহের অভ্যন্তরে রয়েছে এক বিশেষ রোগ প্রতিরোধব্যবস্থা। চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় একে বলে ‘ইমিউন সিস্টেম’। রোগশোকের বিরুদ্ধে ঢাল হিসেবে কাজ করে এই সিস্টেম। কিন্তু অনেক সময় তা আবার শরীরের বিরুদ্ধেই যুদ্ধ ঘোষণা করে বসে। হঠাৎ আক্রমণ করে শরীরের গিঁট, মাংসপেশিসহ অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে। কিন্তু ঠিক কী কারণে এই বিদ্রোহ, তা এখনো জানা যায়নি। আর এই বিদ্রোহের প্রভাব নানা বাত-ব্যথা-বেদনা। ছোট-বড় মিলিয়ে প্রায় ৬০০ রকমের বাত রোগ আছে।

শীতে কি ব্যথা বাড়ে?

অনেকে মনে করেন, শীতকালে বাতের ব্যথা বাড়ে। আসলে কথাটি সেভাবে সত্য নয়। শীতে সব ধরনের বাতের রোগীর ব্যথা বাড়বে, তারা আগের চেয়ে বেশি কষ্ট পাবে—ঢালাওভাবে এ কথা বলা যায় না। এর কোনো বৈজ্ঞানিক তথ্যও নেই। বরং গ্রীষ্ম, বর্ষা বা অন্যান্য ঋতুর চেয়ে শীতকালে বেশির ভাগ রোগের প্রকোপ বা তীব্রতা কম হয়। তবে শ্বাসতন্ত্রের কিছু রোগ যেমন—ক্রনিক ব্রংকাইটিস, নিউমোনিয়া, অ্যাজমা প্রভৃতি শীতকালে বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে।

বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, শীতকালে ব্যথা-বেদনাগুলো অপেক্ষাকৃত বেড়ে যাওয়ার মূল কারণ হলো এই সময়ে মানুষের স্বাভাবিক কার্যক্রমগুলো কমে যাওয়া। শীতের প্রকোপের কারণে সাধারণত মানুষ বেশিক্ষণ বসে বা শুয়ে থাকে। শীতে বায়ুর চাপ কমে যাওয়ায় শরীরের পেশিকলাগুলো প্রসারিত হয় এবং স্নায়ুর ওপর চাপ সৃষ্টি করেও ব্যথাবোধ বাড়ায়।

তা ছাড়া শীতে ঠাণ্ডায় হাত-পায়ের রক্তনালি সংকুচিত হলেও ব্যথার পরিমাণ বাড়ে। এর মধ্যে বড় ধরনের বাত রোগ যেমন—রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস, স্পন্ডাইলো আর্থ্রাইটিস, এনকাইলজিং স্পন্ডাইলাইটিস (তরুণদের বেশি হয়), এসএলই (তরুণীদের বেশি হয়), অস্টিওআর্থ্রাইটিস (বয়স্কদের বেশি হয়) ইত্যাদিতে যাঁরা ভুগছেন, তাঁদের কষ্ট বহুলাংশে বেড়ে যায়। এ ছাড়া পেশি, লিগামেন্ট, হাড় ও স্নায়ুর ব্যথাও বেড়ে যেতে পারে। বিশেষ করে রেনোডস ফেনোমেনন রোগটি যাদের আছে, শীতের প্রকোপে তাদের কষ্ট বেড়ে যেতে পারে। তাই বিশেষভাবে সতর্ক থাকা উচিত।

বাত রোগের সঠিক কারণ এখনো অজানা। এর পরও বিজ্ঞানীরা কিছু কারণ চিহ্নিত করেছেন। যেমন—

• বংশগত বা জেনেটিক কারণ (১০ থেকে ১৫ ভাগ)।

•পরিবেশগত কারণ।

• হরমোনের প্রভাব।

• রক্তে ইউরিক এসিডের মাত্রা বেড়ে গেলে। অনেক সময় থায়াজাইড, এসপিরিন, পাইরাজিনামাইড ইত্যাদি ওষুধেও ইউরিক এসিডের মাত্রা বেড়ে গিয়ে গাউট হতে পারে।

•  ভিটামিন ‘ডি’-এর অভাব।

• উদ্বেগ, চিন্তা ইত্যাদি।

চিকিৎসা
বাতের ব্যথার রোগীদের শীতকালের জন্য আলাদা কোনো চিকিৎসা নেই। তবে ব্যথা অধিক বেড়ে গেলে চিকিৎসকের পরামর্শে ওষুধ সেবন করতে হবে। বাতের ব্যথার ওষুধ দীর্ঘদিন ধরে খেতে হয়। ব্যথানাশক ওষুধ খেলেও খেয়াল রাখতে হবে, যাতে হার্ট, কিডনি, লিভার, ফুসফুস ইত্যাদি ভাইটাল অর্গানগুলোর ক্ষতি না হয়। রোগীদের উচিত নিজের ইচ্ছায় ফার্মেসিতে গিয়ে কোনো ওষুধ ক্রয় করে সেবন করা থেকে বিরত থাকা।

প্রতিরোধে করণীয়
কিছু করণীয় রয়েছে, যাতে শীতকালেও ব্যথামুক্ত অথবা কম মাত্রার ব্যথা নিয়ে থাকা যায়। ফলে বাতের ব্যথা নিয়ন্ত্রণে রেখেই দিন যাপন করা যায়।

স্বাভাবিক কাজকর্ম ও ব্যায়াম : শুধু বাতের রোগীদের জন্য নয়, বরং সবার উচিত শীতকালে স্বাভাবিক কাজকর্ম একটু বেশি করা। লেপ-কম্বল-কাঁথা মুড়ি দিয়ে বেশিক্ষণ বিছানায় শুয়ে থাকা বা বেশির ভাগ সময় বসে থাকা পরিহার করা উচিত। অনেকক্ষণ এক জায়গায় বসে বা দাঁড়িয়ে না থেকে হালকা হাঁটাহাঁটি করুন। নিয়মিত নির্দেশমাফিক হালকা ধরনের ব্যায়ামগুলো করুন। তবে ব্যথা বেড়ে গেলে ব্যায়াম বন্ধ রাখুন।

গরম পোশাক : যেকোনো উপায়েই হোক, শীতের সময় পর্যাপ্ত গরম পোশাকে আবৃত থাকা উচিত, বিশেষ করে অধিক বয়সী মানুষগুলোকে শীতের সময় উষ্ণ রাখার চেষ্টা করতে হবে। এ জন্য যথোপযুক্ত গরম কাপড় পরিধান করা শ্রেয়।

গরম পানি : হালকা গরম পানিতে অজু-গোসল করুন। কুসুম গরম পানি পান করুন। গরম পানির সেঁক (ময়েস্ট হিট) আর্থ্রাইটিসের ব্যথার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আবার ব্যথার জায়গায় ১০ থেকে ১৫ মিনিট গরম বা ঠাণ্ডা সেঁক দিলেও আরাম মেলে।

ভিটামিন ‘ডি’ : শীতকালে সূর্যালোক কম থাকায় ভিটামিন ‘ডি’-এর কিছুটা অভাব দেখা দেয়। তাই বেশি করে ভিটামিন ‘ডি’যুক্ত খাবার খাওয়া উচিত। আর ভিটামিন ‘ডি’ ডিফিসিয়েন্সি হলে পরীক্ষা করে চিকিৎসকের পরামর্শে ওষুধ খাওয়া যেতে পারে। তবে ভালো হয়, সকাল ১০টা থেকে ১২টার মধ্যে ২০-৩০ মিনিটের মতো প্রতিদিন রোদ পোহাতে পারলে। কেননা ভিটামিন ‘ডি’র ৮০ শতাংশের উৎস সূর্য।

এ ছাড়া আরো কিছু নিয়ম মেনে চলা উচিত। যেমন—

• বাত-ব্যথার রোগীরা হাতের ওপর ভর দিয়ে বিছানায় শোয়া এবং ওঠার অভ্যাস করুন।

•নিচু জিনিস যেমন—পিঁড়ি, মোড়া বা ফ্লোরে অনেক্ষণ না বসে থেকে চেয়ারে বসার চেষ্টা করুন। মেরুদণ্ড সোজা করে বসুন।

•হাই হিল বা শক্ত জুতা না পরে নরম জুতা পরার অভ্যাস করুন।

•সম্ভব হলে উঁচু কমোড ব্যবহার করুন। নিচু টয়লেট ব্যবহারে কোন কোন ক্ষেত্রে ব্যথা বাড়তে পারে।

•নরম ফোম পরিহার করে তোষক, জাজিম ইত্যাদি ব্যবহার করুন।

•খুব বেশি ব্যথা হলে চিকিৎসকের পরামর্শে ওষুধ খান, ফিজিওথেরাপি নিন।

খাবারদাবার
যাঁরা বাতজাতীয় রোগে ভুগছেন, তাঁদের উচিত জীবনযাত্রায় পরিবর্তন আনা ও ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখা। এর পাশাপাশি নিয়মিত পুষ্টিসম্পন্ন সুষম খাবার গ্রহণ করাও সহায়ক। এ বিষয়ে পরামর্শ দিয়েছেন ইবনে সিনা ডায়াগনস্টিক এন্ড কনসালটেশন সেন্টার, বাড্ডা শাখার পুষ্টিবিদ উম্মে সালমা তামান্না

ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিড : তৈলাক্ত মাছ বা সামুদ্রিক মাছ যেমন—টুনা, স্যামন, ম্যাকরেল, হেরিং, ফ্ল্যাক্সসিড, ক্যানোলা তেল, ওয়ালনাট, এক্সট্রা ভার্জিন অলিভ অয়েল, ওমেগা-৩ ফর্টিফাইড ফুড (ডিম, মার্জারিন)।

ফল : বেরিস (স্ট্রবেরি, রাস্পবেরি, ব্লুবেরি, ব্ল্যাকবেরি) সাইট্রাস ফ্রুটস (কমলা, মাল্টা, আনারস), বেদানা, জলপাই, আঙুর, অ্যাভোকাডো, তরমুজ ইত্যাদি।

সবজি : গাঢ় সবুজ শাক, ব্রকলি, বাঁধাকপি, ফুলকপি, শালগম, মিষ্টি আলু, গাজর, লাল মরিচ, লেটুস, বেসিল লিফ ইত্যাদি।

দুগ্ধজাতীয় পণ্য : লো ফ্যাট দুধ, দই, পনির।

বিনস : রেড বিনস, কিডনি বিনস, পিন্টো বিনস

এ ছাড়া রোগ প্রতিরোধক্ষমতা বৃদ্ধি করতে পূর্ণশস্য, গ্রিন টি, রসুন, আদা, হলুদ, ধনে, বাদাম, পুদিনাপাতা খেতে পারেন।

বর্জনীয় খাবার
ওমেগা-৬ ফ্যাটি এসিড : কর্ন তেল, সানফ্লাওয়ার তেল, সয়া, চিনাবাদাম, মেয়নেজ, সালাদ ড্রেসিং অতিরিক্ত মাত্রায় খাওয়া যাবে না।

রিফাইন্ড কার্বস : সাদা আটার রুটি, পাস্তা।

সবজি : টমেটো, বেগুন, আলু।

এ ছাড়া রেডমিট, চিনি, কাঁচা লবণ, সম্পৃক্ত ফ্যাট, পূর্ণ ননিযুক্ত দুগ্ধজাতীয় পণ্য, ট্রান্স ফ্যাট, প্রসেসড ফুড, মনোসোডিয়াম গ্লুুটামেট, অ্যালকোহল জাতীয় খাবার থেকে বিরত থাকতে হবে।