বড়দের পাশাপাশি শিশুদেরও ডায়াবেটিস হয়। মূলত এটা টাইপ-১ ডায়াবেটিস। দিন দিন এর প্রকোপ বাড়ছে। তবে সময়মতো রোগ ধরা পড়লে এবং সঠিক চিকিৎসা নিলে শিশুটি সুস্থ থাকে।
ইন্টারন্যাশনাল ডায়াবেটিক ফাউন্ডেশনের তথ্য মতে, বাংলাদেশে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত মোট রোগীর সংখ্যা প্রায় ৭০ লাখ। এর মধ্যে ১৭ হাজারের বেশি শিশু টাইপ ওয়ান ডায়াবেটিসে ভুগছে।
টাইপ-১ ডায়াবেটিস কী?
আমাদের শরীরে ইনসুলিন তৈরি হয় প্যানক্রিয়াসের বিটা সেল থেকে। যদি কোনো কারণে এই বিটা সেল থেকে ইনসুলিন উৎপাদন না হয় অথবা ব্যাহত হয়, তখন রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেড়ে যায়। এতে টাইপ-১ ডায়াবেটিস হতে পারে। একে জুভেনাইল ডায়াবেটিস বা ইনসুলিননির্ভর ডায়াবেটিসও বলা হয়। এই মারাত্মক ঘাটতির ফলে রক্তপ্রবাহ থেকে গ্লুকোজ সব দেহকোষে পৌঁছানো সম্ভব হয় না। ইনসুলিন দিয়ে ঠিকমতো চিকিৎসা করা না হলে শিশুটি মৃত্যুমুখে পতিত হয়। তবে সঠিক সময়ে রোগ ধরা পড়লে এবং সঠিক চিকিৎসা নিলে শিশুটি সুস্থ থাকে।
যাদের হয়
যেকোনো বয়সী শিশু টাইপ-১ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হতে পারে। এমনকি খুব ছোট শিশুদেরও এই রোগ হয়। তবে কিশোর বয়সে যাদের ওজন অনেক বেশি, তাদের টাইপ-২ হওয়ার ঝুঁকি বেশি।
কারণ
ঠিক কী কারণে টাইপ-১ ডায়াবেটিস হয়, সে সম্পর্কে এখনো পুরোপুরি নিশ্চিত হওয়া যায়নি। তবে এখন পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে রিস্ক ফ্যাক্টরগুলো হলো—
❏ পরিবারের রোগের ইতিহাস থাকলে অর্থাৎ বংশগত (চার-সাত বছর এবং ১০-১৪ বছর বয়সীদের)। তবে এর ব্যতিক্রমও আছে।
❏ পরিবেশগত কিছু উপাদানের সংমিশ্রণ।
❏ মাম্পস, রুবেলা, ককজেকি ধরনের ভাইরাসের কারণে অগ্ন্যাশয়ের ইনসুলিন উৎপাদনকারী সেল নষ্ট হলে।
❏ জন্মের প্রথম ছয় মাস মায়ের দুধ পান না করালে।
উপসর্গ
টাইপ-১ ডায়াবেটিসের লক্ষণগুলো অনেকটা হঠাৎ করেই আসে। এর কিছু লক্ষণ হলো—
❏ অস্বাভাবিক তৃষ্ণা পাওয়া বা বেশি বেশি পানি পান করা।
❏ বারবার প্রস্রাব করা।
❏ তীব্র ক্ষুধা অনুভব করা। রাতে ঘুম ভেঙে পানি বা খাবার খাওয়া।
❏ কোনো কারণ ছাড়াই দ্রুত ওজন কমে যাওয়া।
❏ অবসাদ, ক্লান্তি ও দুর্বলতা অনুভব করা। অল্পতে হাঁপিয়ে পড়া, কাজে উৎসাহ কম থাকা।
❏ ক্ষত হলে বা কাটাছেঁড়া থাকলে শুকাতে বেশি সময় লাগা। যেকোনো রোগজীবাণু তাদের বেশি আক্রান্ত করতে পারে এবং পর্যাপ্ত অ্যান্টিবায়োটিক সেবনের পরও ইনফেকশন নিয়ন্ত্রণে না আসা।
❏ বিরক্ত বা অস্বাভাবিক আচরণ, মানসিক অবস্থার পরিবর্তন।
❏ দৃষ্টিশক্তি কমে যাওয়া বা চোখে ঝাপসা দেখা।
ডায়াবেটিস কিটোএসিডোসিস
ডায়াবেটিক রোগীদের জন্য কিটোএসিডোসিস একটি জরুরি অবস্থা, যা হঠাৎ ঘটে থাকে এবং সময়মতো চিকিৎসা না নিলে রোগী জ্ঞান হারিয়ে ফেলতে বা শকেও চলে যেতে পারে। রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ অনেক বেড়ে গিয়ে (হাইপারগ্লাইসেমিয়া) চর্বি ভেঙে রক্তে কিটোন নামের অম্ল তৈরি হতে থাকে এবং ক্রমে এই কিটোন দেহে জমে রক্তের অম্লত্ব অস্বাভাবিক বেড়ে বাইকার্বোনেট কমে যাওয়ার মতো (মেটাবলিক এসিডোসিস) মারাত্মক বিপর্যয় ঘটে।
কেউ যদি কয়েক দিন ইনসুলিন না নেয়, না বুঝে ইনসুলিনের ডোজ বেশি কমিয়ে দেয়, জ্বর বা সংক্রমণের কারণে রক্তে শর্করা যদি বেড়ে যায়, তবে এ ধরনের পরিস্থিতি তৈরি হয়। তাই টাইপ-১ ডায়াবেটিক রোগীদের এক দিনও ইনসুলিন বন্ধ করা উচিত নয়।
জটিলতা
দীর্ঘদিন ধরে টাইপ-১ ডায়াবেটিসে শিশুরা আক্রান্ত থাকলে এবং এর মাত্রা বেশি হলে দেহের প্রধান অঙ্গগুলো, বিশেষ করে স্নায়ু, চোখ ও কিডনির ওপর দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব বিস্তার করে। যেমন—
রেটিনোপ্যাথি : চোখের রেটিনার রক্তনালিগুলো নষ্ট করে ফেলে। এ ছাড়া চোখে ছানি পড়তে পারে। এমনকি অন্ধও হয়ে যেতে পারে।
নেফ্রোপ্যাথি : এটি হলো ডায়াবেটিসজনিত কিডনি রোগ, যাতে কিডনি আক্রান্ত হয়। দীর্ঘস্থায়ী কিডনি বিকল হতে পারে। তাই রোগীদের শর্করা ও রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখাটা খুব জরুরি।
নিউরোপ্যাথি : রক্তে মাত্রাতিরিক্ত গ্লুকোজ কৈশিক নালিকার দেয়ালে ক্ষত সৃষ্টি করে, যেগুলো স্নায়ুর দেখাশোনা করে, বিশেষ করে পায়ের স্নায়ুগুলোর। ফলে পায়ের পাতা থেকে শুরু হয়ে ধীরে ধীরে দেহের ওপরের দিকে অসাড়তা, জ্বলুনি বা ব্যথা অনুভূত হয়। একপর্যায়ে অনুভবক্ষমতা হারিয়ে শিশুটি বিকলাঙ্গ হয়ে যেতে পারে।
ডায়াবেটিক ফুট : ডায়াবেটিক রোগীদের পায়ের রোগ ডায়াবেটিক ফুট বা ডায়াবেটিক পা। এতে পায়ে ইনফেকশন বা ক্ষত হয়। ফলে শিশুটি হাঁটতে পারে না, জটিলতা বাড়ে। অনেক ক্ষেত্রে পা কেটেও ফেলতে হয়।
হরমোনাল সমস্যা : টাইপ-১ ডায়াবেটিসের সঙ্গে থাইরয়েড হরমোন বা অন্যান্য এন্ডোনাল গ্রান্ড আক্রান্ত হতে পারে।
এ ছাড়াও টাইপ-১ ডায়াবেটিসের কারণে আরো কিছু অঙ্গের মারাত্মক জটিলতা দেখা দিতে পারে। তবে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারলে জটিলতাগুলো অনেকটাই কমে যায়।
পরীক্ষা-নিরীক্ষা
ব্ল্যাড সুগার টেস্ট : এই পরীক্ষাটা করালে রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা কত তা জানা যায় বা ডায়াবেটিস আছে কি না তা জানা যায়।
এইচবিএওয়ানসি : এই পরীক্ষায় গত তিন মাসের গড় সুগারের মাত্রা পাওয়া যায়।
অন্যান্য পরীক্ষা : এ ছাড়া কিছু ক্লিনিক্যাল পরীক্ষা-নিরীক্ষা রয়েছে, যেমন চোখের পরীক্ষা, সিরাম ক্রিয়েটিনিন, সিরাম ইলেকট্রোলাইটস, ইউরিন ফর মাইক্রো অ্যালবুমিন, ইউরিন আরএমই ইত্যাদি।
চিকিৎসা ও করণীয়
❏ টাইপ-১ ডায়াবেটিসের প্রধান চিকিৎসা ইনসুলিন যার কোন বিকল্প নেই। ইনসুলিন না নিলে বরং জীবন বিপন্ন হবে।
❏ আক্রান্ত শিশুদের প্রতিদিন এক ঘণ্টা করে শারীরিক ব্যায়াম করাতে হবে।
❏ পুষ্টিবিদদের পরামর্শে সঠিক খাদ্যতালিকা তৈরি করে হেলদি ডায়েট দিতে হবে। রিফাইন সুগার বা সরাসরি চিনিজাতীয় খাবার বর্জন করা উচিত।
❏ চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী নিয়মকানুন মেনে চলতে হবে এবং নিয়মিত ফলো আপে থাকতে হবে।
প্রতিরোধে যা করবেন
স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস
অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তে নিরাপদ ও স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। বিশেষ করে ফাস্ট ফুড ও চর্বিজাতীয় খাবার পিত্জা, বার্গার, কোল্ড ড্রিংকস, চিপস, চকোলেট ইত্যাদি খাবার বর্জন করতে হবে। খাদ্যতালিকায় তাজা ফল ও শাকসবজি রাখতে হবে।
খেলাধুলা ও ব্যায়াম
শিশুরা যাতে মুটিয়ে না যায়, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। খোলা মাঠে প্রতিদিন কমপক্ষে এক ঘণ্টার মতো খেলাধুলা করা বা ব্যায়াম করার অভ্যাস করতে হবে। বেশিক্ষণ টিভি না দেখা, মোবাইল ফোন বা কম্পিউটারে দুই ঘণ্টার বেশি থাকা বা অবস্থান করা ঠিক নয়। বসে বসে ভিডিও দেখা বা কম্পিউটার গেমস খেলার অভ্যাস বন্ধ করাসহ জোরে হাঁটা বা জগিং, সাঁতার কাটা, সাইক্লিংয়ের মতো ব্যায়াম বেছে নিতে হবে। শিশুরা যাতে স্বাভাবিক শারীরিক ওজনের হয়, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।
মায়ের দুধ ও টিকা
জন্মের পর ছয় মাস পর্যন্ত শিশুকে মায়ের বুকের দুধ খাওয়ানো নিশ্চিত করতে হবে। যথাসময় মামস্, রুবেলা ইত্যাদি ভাইরাসের টিকাগুলো দিতে হবে।