রিউমাটিক ফিভার/বাত জ্বরের লক্ষণ
বাতজ্বর (Rheumatic fever) একটি প্রদাহজনিত রোগ যা হার্ট, জয়েন্ট, চর্ম, মস্তিষ্ক কে আক্রান্ত করতে পারে। সাধারণত গলায় সংক্রমণের ২ থেকে ৪ সপ্তাহ পরে এই রোগ শুরু হয়। বিটা-হিমোলাইটিক স্ট্রেপটোকক্কাস নামক এক ধরনের ব্যাক্টেরিয়ার সংক্রমণে এই রোগ হয়। বাতজ্বর রোগীদের বয়স সাধারণত ৫ থেকে ১৫ বছর পর্যন্ত হয়ে থাকে। আবার ২৫ থেকে ৩৫ বছর বয়সীদের মধ্যেও এই রোগ হতে পারে। বাতরোগের অনেক উপসর্গ ও বাতজ্বরের অনেক উপসর্গের মধ্যে মিল থাকায় এই রোগের নাম রাখা হয়েছে বাতজ্বর। বাতজ্বরের সাধারন লক্ষণসমূহ হচ্ছে জ্বর, জয়েন্টে ব্যথা, ইরায়থেমা মারজিনেটাম ইত্যাদি। এ রোগে প্রায় অর্ধেক ক্ষেত্রেই হার্ট আক্রান্ত হয়। এই রোগে ব্যক্তির নিজের শরীরের টিস্যুর বিরুদ্ধে অ্যান্টিবডি তৈরি হয়। আবার যাদের শরীরে এই রোগের জিন রয়েছে তারা অন্যদের তুলনায় খুব সহজেই এই রোগে আক্রান্ত হতে পারে। এছাড়াও পুষ্টিহীনতা, দারিদ্র্য ইত্যাদি কারনেও এ রোগ হয়।
বাতজ্বর নির্ণয়ের সময় কিছু জরুরি বিষয় অবশ্যই মনে রাখতে হবে
- বাতজ্বর নির্ণয় করা সম্ভব হলে একটি শিশুকে দীর্ঘদিন অর্থাৎ বছরের পর বছর ধরে পেনিসিলিন ইনজেকশন বা বড়ি গ্রহন করতে হয়। তাই, এ রোগ আছে কিনা সে সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে চিকিৎসা শুরু করা উচিত।
- বাতজ্বরে সাধারনত গলা, পিঠ, হাত ও পায়ের ছোট ছোট গিরা আক্রান্ত হয় না।
- স্ট্রেপটোকক্কাস ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণে টনসিল অথবা গলার প্রদাহ হলে রক্তে এএসও টাইটার বাড়ে। যেহেতু যেকোনো নিরীহ টনসিল সংক্রমণেই এ পরীক্ষার রিপোর্ট অস্বাভাবিক আসতে পারে, তাই রক্তে এএসও টাইটার বৃদ্ধি পেলেই এটি বাতজ্বরের কোনো নিশ্চিত ও একমাত্র প্রমাণ নয়। বাতজ্বরের অনেকগুলো সুস্পষ্ট লক্ষণ ও উপসর্গ রয়েছে, যেগুলোর সমন্বয়ে রোগটি নির্ণয় করতে হয়।
- ৫০ শতাংশ ক্ষেত্রে হূৎপিণ্ডে প্রদাহ হয় না।
বাতজ্বর কেন হয়?
বাতজ্বরে সাধারনত বিটা হেমোলাইটিক স্ট্রেপটোকক্কাস নামক এক ধরনের জীবাণুর সংক্রমনের কারনে হয়। দারিদ্র্য, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার অভাব, ঠাণ্ডা ও স্যাঁতসেঁতে পরিবেশে এবং অজ্ঞতাই এ রোগের প্রধান কারণ। এছাড়াও, যেসব শিশু দীর্ঘ দিন ধরে খোসপাঁচড়া ও টনসিলের রোগে আক্রান্ত, তাদেরও বাতজ্বরে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা অনেক বেশি।
বাতজ্বরের লক্ষণ ও উপসর্গসমূহ
বাতজ্বরের মুখ্য ও গৌণ কিছু উপসর্গ আছে, যার সমন্বয়ে রোগ নির্ণয় করতে হয়। যদি দুটি মুখ্য উপসর্গ ও একটি গৌণ উপসর্গ মিলে অথবা একটি মুখ্য উপসর্গের সঙ্গে দুটি গৌণ উপসর্গ মিলে যায় এবং এর সঙ্গে স্ট্রেপটোকক্কাস ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ প্রমাণিত হয়, তবেই কেবল বাত জ্বর হয়েছে বলে নিশ্চিত হতে হবে।
মুখ্য উপসর্গ
চামড়ার নিচে ক্ষুদ্র ব্যথাহীণ পিন্ড অথবা ত্বকে লালচে দাগ, অস্থিসন্ধির প্রদাহজনিত ব্যথা ও ফুলে যাওয়া, একটি সন্ধি ভালো হয়ে গেলে এটি আবার অন্যটিকে আক্রমণ করে, স্নায়ুজটিলতায় পেশির অস্বাভাবিক চলন, হূৎপিণ্ডের প্রদাহ বা কার্ডাইটিস ইত্যাদি।
গৌণ উপসর্গ
জ্বর, অস্থিসন্ধিতে ব্যথা, রক্তে ইএসআর বা সিআরপি বৃদ্ধি, অল্পতে ক্লান্ত বা দুবর্ল বোধ করা, বুকে ব্যথা বা বুক ধড়ফড় করা, শ্বাসকষ্ট, ইসিজিতে বিশেষ পরিবর্তন ইত্যাদি।
কখন ডাক্তার দেখাবেন?
শিশুর গলায় ব্যথা হলে অথবা টনসিলের সমস্যা হলে এবং এর লক্ষণ বা উপসর্গ দেখা দেয়ার সাথে সাথেই শিশুকে ডাক্তারের কাছে নিতে হবে। উপযুক্ত চিকিৎসা গ্রহনের মাধ্যমে বাত জ্বর প্রতিরোধ করা যায়। কিছু কিছু লক্ষণ এবং উপসর্গ দেখা দেয়ার সাথে সাথে শিশুকে ডাক্তারের কাছে নিতে হবে, যেমন- গলায় ব্যথার সাথে গলায় ফোলা ভাব থাকলে, কোন কিছু খেতে সমস্যা হলে, ঠান্ডার কোন উপসর্গ ছাড়াই নাক দিয়ে পানি পড়লে, গিরা বা অস্থিসন্ধিতে ব্যথা থাকলে, নাক দিয়ে রক্ত আসলে যা সাধারনত ৩ বছরের কম বয়সী শিশুদের ক্ষেত্রে দেখা যায় ইত্যাদি।
কাদের বাতজ্বর হওয়ার ঝুঁকি বেশি?
- পরিবারের অন্য কেউ বাতজ্বরে আক্রান্ত থাকলে।
- ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা, সুষ্ঠ পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থা ও পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার অভাব, দারিদ্র, পুষ্টির অভাব ইত্যাদি নানান কারন রোগের জীবাণু বিস্তারে সহায়ক।
কি ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার প্রয়োজন হতে পারে?
চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী কিছু শারীরিক পরীক্ষা, রক্তের পরীক্ষা, ইসিজি, ইকোকার্ডিওগ্রাফী ইত্যাদি করতে হতে পারে।
চিকিৎসা
ব্যথা এবং রোগের অন্যান্য উপসর্গ ভালো না হওয়া পর্যন্ত রোগীকে প্রয়োজনে কয়েক সপ্তাহ বা কয়েক মাস পর্যন্ত সম্পূর্ণ বিশ্রামে থাকতে হবে এবং আক্রান্ত জয়েন্ট নড়াচড়া করা থেকে বিরত থাকতে হবে। ব্যথানাশক ঔষধ হিসেবে অ্যাসপিরিন খাওয়া যেতে পারে। প্রদাহ কমানোর জন্য অ্যাসপিরিনের পাশাপাশি কর্টিকোস্টেরয়েড যেমন- প্রেডনিসোলন ব্যবহার করা যেতে পারে। এর পাশাপাশি অ্যান্টিবায়োটিক যেমন- বেনজাথিন পেনিসিলিন, ফিনক্সিমিথাইল পেনিসিলিন, ইরাইথ্রোমাইসিন প্রভৃতি ব্যবহার করা যেতে পারে। যেকোনো ঔষধ সেবনের পূর্বে অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ গ্রহন করতে হবে।
প্রতিরোধ
শিশুর পরিমিত পুষ্টি নিশ্চিত করতে হবে। শিশুর শরীরের পুষ্টিমান সঠিক হলে গলায় জীবাণুর আক্রমণের পরেও বাত জ্বর হওয়ার আশঙ্কা কম থাকে। অপরদিকে ছোটবেলায় দীর্ঘদিন ধরে অপুষ্টিতে আক্রান্ত, যেসব শিশুর রক্তে আমিষ ও লৌহের অভাব রয়েছে, তাদের বাতজ্বর হওয়ার আশঙ্কা বেশি থাকে। তাই শিশুর সঠিক পুষ্টি নিশ্চিত করতে হবে।
বাতজ্বরের জীবাণু নাক, গলা ও ত্বকে বাস করে। অপরিষ্কার থাকলে, ঘরদোর পরিচ্ছন্ন-পরিচ্ছন্ন না রাখলে এ রোগের জীবাণু একজন থেকে অন্যজনে ছড়াতে পারে। প্রতিদিন সাবান দিয়ে গোসল করলে, হাত ও নাক পরিষ্কার রাখলে, প্রতিদিন অন্তত একবার গড়গড়া করে গলা পরিষ্কার করলে এ রোগের জীবাণুর আক্রমন প্রতিরোধ করা সম্ভব হতে পারে। প্রথম থেকেই গলায় সংক্রমণের সঠিক চিকিৎসা গ্রহন করলে বাত জ্বর হওয়ার সম্ভাবনা অনেক কমে যায়। স্ট্রেপ্টোকক্কাস ব্যাকটেরিয়া দ্বারা কণ্ঠ নালীর সংক্রমণ হলে, অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করে বাতজ্বর প্রতিরোধ করা যায়।
বাত জ্বর নিয়ে কিছু কথা
বাতজ্বর কোন ছোঁয়াচে রোগ নয়
বাতজ্বর ছোঁয়াচে রোগ নয়। বাতজ্বরের রোগীর সঙ্গে থাকলে, খেলে, ঘুমালে এমনকি ঘনিষ্ঠভাবে মেলামেশা করলেও বাত জ্বর হওয়ার কোন সম্ভাবনা নেই। গর্ভাবস্থায় মা থেকে শিশুর দেহে সংক্রমণের কোন আশঙ্কা নেই। কিন্তু স্ট্রেপ গলদাহের সময় কাছাকাছি থাকলে অথবা বেশি কাছ কথা বললে অন্যের মধ্যে জীবাণুর সংক্রমন হতে পারে।
জ্বর ও গিরাব্যথা হলেই কিন্তু বাতজ্বর নয়
গিরা ফোলা অথবা ব্যথাসহ জ্বর আরও অনেক রোগে হতে পারে, তাই গিরাব্যথা হলেই বাতজ্বর হয়েছে বলে মনে করা যাবে না। বাত জ্বরের গিরা ফোলা বা ব্যথা কিন্তু সহজেই ভালো হয়ে যায়। তাই চিকিৎসা নেওয়া সত্ত্বেও কোনো রোগীর গিরাব্যথা ভালো না হলে, সেক্ষেত্রে বাতজ্বর না হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।
রক্তের এএসও টাইটার বেশি হলেই কিন্তু বাতজ্বর নয়
বাতজ্বর নির্ণয়ের জন্য রক্তের কোনো সুনির্দিষ্ট পরীক্ষা নেই। তাই সাধারনত বাত জ্বর সন্দেহ হলেই চিকিৎসকেরা রক্তের অ্যান্টি-স্ট্রেপটোলাইসিন-ও বা এ এস ও পরীক্ষা করে থাকেন। এএসও বেশি হওয়ার অর্থই কিন্তু বাতজ্বর নয়। বাতজ্বর হলে অবশ্যই উপরোল্লিখিত মূখ্য ও গৌণ লক্ষণ বা উপসর্গগুলো থাকতে হবে। কোন লক্ষণ বা উপসর্গের উপস্থিতি না থাকলে বাতজ্বর হয়নি বলে ধরা হবে।
উপসর্গ ভালো হলেও ওষুধ খাওয়া চালিয়ে যেতে হবে
উপসর্গ ভালো হয়ে গেলেই বাত জ্বরের চিকিৎসা বন্ধ করা যাবে না। বাতজ্বর একবার হলে বারবার হতে পারে। তাই বাতজ্বরে আক্রান্ত হলে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী নিয়মিত পেনিসিলিন ব্যবহার করতে হবে, যাতে পুনরায় বাতজ্বরে আক্তান্ত হতে না হয়।