টিউবারকিউলোসিস বা যক্ষা একটি সংক্রামক রোগ। যক্ষায় সংক্রমিত প্রতি ১০ জনের মধ্যে একজনের সক্রিয় যক্ষা হতে পারে। যক্ষায় মানুষের কিডনি, মেরুদন্ড অথবা মস্তিষ্কও আক্রান্ত হতে পারে।
যক্ষা কি
যক্ষা একটি মারাত্মক সংক্রামক রোগ যা প্রাথমিকভাবে ফুসফুসকে আক্রান্ত করে।
যক্ষা রোগের জীবাণু কিভাবে ছড়ায়
বাতাসের মাধ্যমে যক্ষা রোগের জীবাণু ছড়ায়। যক্ষা রোগে আক্রান্ত ব্যক্তির হাঁচি বা কাশির মাধ্যমে রোগের জীবাণু বাতাসে গিয়ে মিশে এবং রোগের সংক্রমণ ঘটায়।
যক্ষা হয়েছে কি করে বুঝবেন
যক্ষার লক্ষণ ও উপসর্গগুলো হলো :
সাধারণ লক্ষণ
- অস্বাভাবিকভাবে ওজন হ্রাস পাওয়া
- অবসাদ অনুভব করা
- জ্বর
- রাতে ঘাম হওয়া
- কাপুনী
- ক্ষুধা মন্দা
অন্যান্য লক্ষণ
- তিন সপ্তাহ বা এর অধিক সময় ধরে কাশি
- কাশির সাথে রক্ত যাওয়া
- বুকে ব্যথা অথবা শ্বাস নেয়ার সময় ও কাশির সময় ব্যথা হওয়া
যক্ষার সংক্রমণ (TB Infection) এবং সক্রিয় যক্ষা(Active TB)
শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে ফুসফুসে যক্ষার জীবাণু প্রবেশ করলে নিচের যে কোনটি হতে পারে :
- রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার কারণে যক্ষার জীবাণু ধ্বংস হয়ে যেতে পারে।
- জীবাণুগুলো ফুসফুসে স্থায়ীভাবে আরও দ্বিগুণ হয়ে থেকে যেতে পারে। এর ফলে যক্ষার সংক্রমণ হতে পারে তবে এর উপসর্গগুলো বোঝা যায় না এবং রোগ ছড়ায় না।
- রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল হলে যক্ষার জীবাণু ফুসফুসে এবং শরীরের অন্যান্য অংশে ছড়িয়ে যেতে পারে এবং তা রোগ প্রতিরোধী কোষগুলো ধ্বংস করে দিতে পারে।
- বছরের পর বছর ধরে যক্ষার জীবাণু শরীরে থাকলে পরবর্তীতে এটি সক্রিয় যক্ষায় রূপ নিতে পারে। সাধারণত বয়স, ঔষধ সেবন, অপুষ্টি, কেমোথেরাপী, মদপান ইত্যাদির জন্য রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে গেলে সক্রিয় যক্ষা হতে পারে। সংক্রমণের প্রথম দুই বছরের মধ্যে যক্ষা হওয়ার ঝুঁকি বেশি থাকে।
এইডস এবং যক্ষা (AIDS and TB)
এইচআইভি (এইডস) এর সংক্রমণের ফলে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা খুবই দুর্বল হয়ে যায়। এর ফলে যক্ষার জীবাণুকে নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হয়ে পড়ে। এর ফলে এইচআইভি সংক্রমিত লোকদের মধ্যে সক্রিয় যক্ষা হবার সম্ভাবনা খুব বেশি থাকে। এমনকি এইডস এ আক্রান্ত ব্যক্তিদের মৃত্যুর একটি প্রধান কারণ হলো যক্ষা।
ঔষধ প্রতিরোধক যক্ষা (Drug Resistant TB)
যখন কোন এ্যান্টিবায়োটিক যক্ষা রোগের সকল জীবাণু ধ্বংস করতে ব্যর্থ হয় তখনই ঔষধ প্রতিরোধক যক্ষার সূত্রপাত হয়।
ঔষধ প্রতিরোধক যক্ষার মূল কারণগুলো হলো :
- পর্যাপ্ত চিকিৎসা গ্রহণ না করা
- ভুল ঔষধ সেবন
- চিকিৎসার কোর্স সম্পূর্ণ না করা
কখন ডাক্তার দেখাবেন
যক্ষার লক্ষণ ও উপসর্গ দেখা দেয়ার সাথে সাথে ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ করতে হবে।
কি ধরণের পরীক্ষা-নিরীক্ষার প্রয়োজন হতে পারে
সাধারণ পরীক্ষা
- ত্বকের পরীক্ষা
- রক্তের পরীক্ষা
- কফ পরীক্ষা
অন্যান্য পরীক্ষা
- বুকের এক্স-রে পরীক্ষা অথবা সিটি স্ক্যান
- কালচার টেস্ট
পরীক্ষার ফল নেতিবাচক হলেও অনেক সময় যক্ষার সংক্রমণ হতে পারে। যেমন :
- যক্ষার সংক্রমণের ৮-১০ সপ্তাহ পরে তা ত্বকের পরীক্ষায় ধরা পড়ে। তার আগে পরীক্ষা করলে ধরা নাও পড়তে পারে
- এইডস এর মতো কোন রোগের কারণে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে গেলে অনেকসময় পরীক্ষায় যক্ষা রোগ ধরা পড়ে না। এছাড়া এইডস এবং যক্ষা রোগের লক্ষণ ও উপসর্গ গুলো প্রায় এক রকম হওয়ায় এইডস রোগীদের যক্ষা রোগ নির্ণয়ের বিষয়টি জটিল হয়ে থাকে।
- হামের টিকা নিলে এগুলোতে অনেক সময় জীবন্ত জীবাণু (Live virus) থাকে, এর জন্য ত্বক পরীক্ষায় যক্ষা ধরা নাও পড়তে পারে।
- শরীরে যক্ষা রোগের জীবাণু বেশী মাত্রায় ছেয়ে গেলে (Overwheliming TB disease) ত্বকের পরীক্ষায় রোগের জীবাণু ধরা নাও পড়তে পারে
- অনেক সময় সঠিকভাবে পরীক্ষা না করলেও এতে যক্ষা রোগের জীবাণু ধরা পড়ে না।
কি ধরণের চিকিৎসা আছে
ডটস পদ্ধতিতে অর্থাৎ স্বল্পমেয়াদী, সরাসরি পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে যক্ষা রোগের চিকিৎসা করা হয়। এজন্য ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী রোগের ধরণ, মাত্রা এবং রুগীর বয়স অনুসারে ঔষধের কোর্স সম্পূর্ণ করতে হবে। যক্ষার চিকিৎসার মধ্যে রয়েছে:
- এন্টিবায়োটিক সেবন। সাধারণত ৬-৯ মাস ব্যাপী এন্টিবায়োটিক ঔষধ সেবন করতে হবে
- শিশুদের ক্ষেত্রে Streptomycin সেবন
- গর্ভবতী মহিলাদের ক্ষেত্রে Isoniazid Rifampin, এবং Ethambutol সেবন
যক্ষা রোগ কিভাবে প্রতিরোধ করা যায়
- জন্মের পর পর প্রত্যেক শিশুকে বিসিজি টিকা দেয়া
- হাঁচি-কাশি দেয়ার সময় রুমাল ব্যবহার করা
- যেখানে সেখানে থুথু না ফেলা
- রোগীর কফ থুথু নির্দিষ্ট পাত্রে ফেলে তা মাটিতে পুঁতে ফেলা
যক্ষা কেন হয় ?
মাইক্রোব্যাকটেরিয়াম টিউবারকিউলোসিস নামক এক ধরণের জীবাণুর সংক্রমণের মাধ্যমে যক্ষা হয়।
যক্ষা কয় ধরনের হয়ে থাকে?
যক্ষা দুই ধরণের হয় :
- সুপ্ত বা Latent TB : এক্ষেত্রে যক্ষার সংক্রমণ হলেও জীবাণুগুলো সক্রিয় থাকে না এবং সমস্যার কোন লক্ষণ দেখা যায় না।
- সক্রিয় বা Active TB : এক্ষেত্রে আক্রান্ত ব্যক্তি অসুস্থ হয়ে পড়ে এবং তার থেকে অন্যরাও আক্রান্ত হতে পারে।
কাদের যক্ষা হবার সম্ভাবনা বেশি রয়েছে ?
যাদের যক্ষা হবার সম্ভাবনা বেশি রয়েছে তারা হলেন-
- রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা যাদের কম
- যক্ষায় সংক্রমিত ব্যক্তির ঘনিষ্ঠ সংস্পর্শে আসা ব্যক্তি
- বয়স্ক ব্যক্তি
- অপুষ্টি
- যারা সুষম খাদ্য গ্রহণ করেন না
- যারা দীর্ঘদিন ধরে মাদক সেবন করছেন
যক্ষার কারণে কি ধরণের জটিলতা দেখা দিতে পারে ?
যক্ষার কারণে নিচের জটিলতাগুলো দেখা দিতে পারে যেমন :
- ফুসফুসের ক্ষতি
- অস্থিসন্ধি ব্যথা, ক্ষয়
- মেনিনজাইটিস (মস্তিষ্ক এবং স্নায়ু সংক্রমিত হলে)
- মিলিয়ারি টিবি (Miliary TB) (সমস্ত শরীরে সংক্রমিত হলে )
এ্যান্টিবায়োটিক সেবনের ফলে কি ধরণের পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে?
এ্যান্টিবায়োটিক সেবনের ফলে নিম্নের পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া গুলো দেখা দিতে পারে:
- বমি বমি ভাব অথবা বমি
- ক্ষুধামন্দা
- ত্বক হলদে হয়ে যাওয়া
- গাঢ় রঙয়ের প্রস্রাব
- কোন কারণ ছাড়াই তিন দিনের অধিক জ্বর থাকা
- পেট যন্ত্রণা
- চোখে অস্পষ্ট দেখা
এ্যান্টিবায়োটিক সেবন করলে যদি উপরোক্ত লক্ষণ ও উপসর্গ দেখা দেয় তাহলে ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ করতে হবে।
যক্ষা রোগ কি ভাল হয়?
নিয়মিত, সঠিকমাত্রায় ও পূর্ণ মেয়াদের চিকিৎসায় যক্ষা রোগ ভাল হয়।