মানসিক রোগ হলো মস্তিষ্কের এক ধরনের রোগ৷ এ ধরনের অসুস্থতায় মানুষের আচার আচরণ কথা-বার্তা চিন্তা-ভাবনা অস্বাভাবিক হয়ে যায়৷
মানসিক রোগ দু ধরনের হতে পারে:
* মৃদু ধরনের মানসিক রোগ
* তীব্র ধরনের মানসিক রোগ
মৃদু ধরনের মানসিক রোগ
এ ক্ষেত্রে জীবনের স্বাভাবিক অনুভূতিগুলো (দুঃখবোধ, দুশ্চিন্তা ইত্যাদি) প্রকট আকার ধারণ করে৷ এ ক্ষেত্রে যে সকল লক্ষণগুলো দেখা যায় তা হলো: অহেতুক মানসিক অস্থিরতা, দুশ্চিন্তা-ভয়ভীতি, মাথাব্যথা, মাথাঘোরা, খিঁচুনি, শ্বাসকষ্ট, বুক ধরফর করা, একই চিন্তা বা কাজ বারবার করা (শুচিবাই), মানসিক অবসাদ, বিষণত্না, অশান্তি, বিরক্তি, অসহায় বোধ, কাজে মন না বসা, স্মরণশক্তি কমে যাওয়া, অনিদ্রা, ক্ষুধামন্দা, আত্মহত্যার করার প্রবণতা বেড়ে যায় ইত্যাদি৷
তীব্র ধরনের মানসিক রোগ
এ ক্ষেত্রে আচার আচরণ কথাবার্তা স্পষ্টভাবে অস্বাভাবিক হয় ফলে আশেপাশের মানুষরা এটা বুঝতে পারে৷ এ ক্ষেত্রে যে সকল লক্ষণগুলো দেখা যায় তা হলো: অহেতুক মারামারি, ভাঙচুর করা, গভীর রাতে বাড়ির বাইরে চলে যাওয়া, আবোল-তাবোল বলা, সন্দেহ প্রবণতা, একা একা হাসা ও কথা বলা, নিজেকে বড় মনে করা, বেশি বেশি খরচ করা, স্বাভাবিক বিচারবুদ্ধি লোপ পাওয়া, ঠিকমতো ঘুম না হওয়া, খাওয়া-দাওয়া ঠিকমতো করে না৷
সাধারণ কিছু মানসিক রোগের নাম নিচে দেওয়া হলো-
১. সিজোফ্রেনিয়া
২. মৃগী রোগ
৩. হিসটেরিয়া
৪. বিষন্নত
৫. মাদকাসক্তি
সিজোফ্রেনিয়া
সিজোফ্রেনিয়া একটি মারাত্মক মস্তিকের রোগ৷ এতে মনের স্বাভাবিকতা হারিয়ে যায় এবং মস্তিস্কের বিঘ্ন ঘটে৷মূল কারণ জানা না গেলেও সিজোফ্রেনিয়ার জন্য নিম্নলিখিত কারণগুলো দায়ী বলে মনে করা হয় –
* পারিবারিক এবং বংশগত হতে পারে ( মা, বাবার কারো থাকলে তাদের বাচ্চাদের হওয়ার সম্ভবনা বেশি থাকে)৷
* গর্ভবতী মায়েদের মধ্যে অনেক সময় দেখা দেয়৷
* পুষ্টিহীনতার কারণে হতে পারে৷
* রোগজীবাণু দ্বারা মস্তিস্কের সংক্রমণ ঘটলে হতে পারে৷ যেমন-ভাইরাস
* বিভিন্ন ঔষুধের কারণে হতে পারে৷যেমন-ডায়ইউরেটিস
* মাথায় আঘাতজনিত কারণে হতে পারে৷
লক্ষণ:
* রোগীর চিন্তাশক্তি নষ্ট হয়ে যায়৷
* রোগী সামাজিক পরিবেশের সাথে খাপ খাইয়ে চলতে পারে না এবং সমাজ থেকে পৃথক হয়ে যায়৷
* মানসিক জীবন খণ্ডিত হয়ে যায়৷
* মানসিকভাবে অস্থিতিশীল হয়৷
* রোগীর মনে হয় অন্যেরা তার চিন্তাভাবনা টের পেয়ে যাচ্ছে৷
* রোগী মনে করে তার কর্মব্যস্ততা অন্যের দ্বারা পরিচালিত হয়৷
* রোগীর দৃষ্টিভ্রম হয়৷
* রোগী মনে করে তার চারপাশের সবাই তার প্রতি ষড়যন্ত্র করছে এবং গোপনে তার ক্ষতি করার চেষ্টা করছে৷
চিকিৎসা
দ্রত রোগীকে মানসিক ডাক্তার দেখাতে হবে৷
প্রতিরোধ :
* মানসিক চাপ কমাতে হবে৷
* মদ এবং নেশাজাতীয় খাবার পরিহার করতে হবে৷
* ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী নিয়মিত ঔষুধ সেবন করবেন৷
মৃগীরোগ
মৃগী রোগ আমাদের দেশে একটি অতি পরিচিত রোগ৷ মৃগী রোগ যে কোনো বয়সে হতে পারে৷ এটা কোনো সংক্রামক রোগ নয়৷ মৃগী রোগ একটি গুরুতর স্নায়ু রোগ৷ মস্তিস্ক মানুষের শরীরের বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনা করে৷ মস্তিস্কের কোষগুলি যদি হঠাত্ করে অতিমাত্রায় উত্তেজিত হয়ে পড়ে তখন মৃগী রোগ দেখা যায়৷ মৃগী রোগের খিঁচুনি হয় এবং রোগী অজ্ঞান হয়ে যায়৷ মৃগী রোগের একটি বৈশিষ্ট হলো রোগী বার বার আক্রান্ত হয় কিন্তু আক্রান্তের পর পুরোপুরি সুস্থ হয়ে যায়৷
কারণ:
মৃগী রোগের প্রাথমিক কারণ জানা যায়নি তবে নিম্নলিখিত কিছু কারণে মৃগী রোগ হতে পারে৷
* মাথায় আঘাত পেলে
* জটিল ও দেরিতে প্রসব হলে
* মস্তিস্কের প্রদাহ হলে যেমন-মেনিনজাইটিস
* মস্তিস্কের টিউমার হলে
* বেশি পরিমান মদ্যপানের অভ্যাস থাকলে
মৃগী রোগের শ্রেণী বিভাগ
১. সাধারণ
ক) বড় ধরনের মৃগী রোগ
খ) মৃদু ধরনের মৃগী রোগ
২. শরীরের কোনো নির্দিষ্ট অংশে
বড় ধরনের মৃগী রোগের লক্ষণ
* এই রোগ সাধারণত কয়েক ঘন্টা থেকে কয়েক দিন পর্যন্ত থাকতে পারে৷ এসময় রোগীর আচরণে পরিবর্তন আসে৷
* ফিট বা খিঁচুনি হবার পূর্বে রোগী বুঝতে পারে৷
* রোগী জ্ঞান হারায় ও মাটিতে পড়ে যায়৷ সবগুলো মাংশ পেশী টান টান হয়ে যায় তখন কান্নার মত চিত্কার করে এবং রোগী নীল বর্ণ হতে পারে৷ সাধারণত ২০-৩০ সেকেন্ড রোগীর এ অবস্থা স্থায়ী হয়৷
* ঝাঁকুনির মত খিঁচুনি শুরু হয়৷ মুখ দিয়ে ফেনা বের হয়৷ রোগী জিহ্বা কামড় দিয়ে রাখতে পারে৷ রোগীর অজান্তেই প্রস্রাব, পায়খানা বেরিয়ে আসতে পারে৷ রোগীর এ অবস্থা প্রায় ৩০ সেকেন্ড স্থায়ী হয়৷
* রোগীর শরীর আস্তে আস্তে শীথিল হয়ে আসে৷ রোগী মুর্ছিত অবস্থায় থাকে ও আস্তে আস্তে গভীরঘুমে ঘুমিযে যায়৷ রোগী জেগে উঠার পর কিছু সময়ের জন্য সঠিকভাবে চিন্তা করতে পারে না এবং কি ঘটেছে সে ব্যাপারে কিছুই মনে করতে পারে না৷ মাঝে মাঝে মাথা ব্যথা করে৷
মৃদু ধরনের মৃগী রোগের লক্ষণ
* হঠাৎ করে অজ্ঞান হয়ে যায়৷ এটা ১০ থেকে ১৫ সেকেন্ড স্থায়ী থাকে৷
* কখনও অজ্ঞান হওয়ার সাথে সাথে খিঁচুনি শুরু হয়৷
* খুব কম রোগী অজ্ঞান হয়ে মাটিতে পড়ে যায়৷ আবার সাথে সাথে জ্ঞান ফিরে দাঁড়িয়ে যায়৷
শরীরের কোনো নির্দিষ্ট অংশে খিঁচুনি
এটা বিভন্ন রকমের হতে পারে৷ এখানে জ্ঞান হারানোর সাথে কোনো সম্পর্ক নেই৷ শরীরের নির্দিষ্ট জায়গায় খিঁচুনি হতে পারে৷ বিভিন্ন রকমের মতিভ্রম হতে পারে৷ খিঁচুনি এক অঙ্গ থেকে বাড়তে বাড়তে পুরো শরীরে হতে পারে৷ রোগী অজ্ঞান হতে পারে আবার নাও হতে পারে৷ খিচুনি বন্ধ হওয়ার পর ঐ অঙ্গে প্যারালাইসিস হতে পারে৷
যে সকল কারণে মৃগী রোগীর খিঁচুনি হতে পারে
* ঠিকমতো ঘুমাতে না পারলে ৷
* মানসিক চাপের কারণে হতে পারে৷
* শারীরিক মানসিক অতিরিক্ত খঁাটুনী করলে হয়৷
* সংক্রমণ রোগ এবং জ্বরের কারণে হতে পারে৷
* কিছু ঔষুধ, মদ অথবা নেশা জাতীয় কিছু পান করলে হতে পারে৷
* আলোর ঝলকানি, টিভির খুব সামনা সামনি বসে টিভি দেখলে হতে পারে৷
* এছাড়াও উচ্চ শব্দ, গরম পানিতে গোসল করলে, জোরে গান বাজনা শুনলে হতে পারে৷
চিকিত্সা :
* ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে হবে৷
* রোগীকে নিউরো মেডিসিন (স্নায়ু) বিশেষজ্ঞের সাথে যোগযোগ করতে হবে৷
* ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী ঔষুধ খেতে হবে৷
রোগী যখন ফিট হয়ে যাবে তখন করণীয়
* রোগীকে বিপদজনক জায়গা থেকে সরিয়ে আনতে হবে৷ যেমন-আগুন, পানি যন্ত্রপাতি ইত্যাদি৷
* রোগী যাতে অন্য কোনো প্রকার আঘাত না পায় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে৷
* মাথাটি পাশ ফিরিয়ে এবং সামান্য নিচের দিকে হেলান দিয়ে রাখতে হবে৷ যেন ভালোভাবে শ্বাস-প্রশ্বাস নিতে পারে ও মুখের ফেনা বা লালা গড়িয়ে পড়ে যেতে পারে৷
* রোগীর চারিদিকে মানুষের ভীড় করা যাবে না৷
* রোগীকে ঘুমাতে দিতে হবে৷ প্রয়োজনে রোগীকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে হবে৷
পরামর্শ
* যে সকল কাজ জীবনের প্রতি ঝুঁকিপূর্ণ সে সকল কাজ মৃগী রোগীদের করা উচিত নয়৷ যেমন-গাড়ী চালানো, আগুনের পাশে কাজ করা, যন্ত্রপাতি চালানো, উঁচুতে কাজ করা ইত্যাদি৷
* সাঁতার কাটা, গাড়ী চালানো, সাইকেল চালানো ইত্যাদি পুরোপুরি বাদ দিতে হবে৷
* সাধারণ কাজ কর্ম যেমন- স্কুলে যাওয়া চালিয়ে যেতে হবে৷ রোগীদের সাথে স্বাভাবিক আচরণ করতে হবে৷
* যে সমস্ত জিনিস মৃগী রোগের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয় সেগুলো বাদ দিতে হবে৷
হিসটেরিয়া
হিসটেরিয়া এমন একটি রোগ যেখানে স্নায়ুবিক কার্য নষ্ট হয় যার সঙ্গে কোনো দৃশ্যমান রোগের সংস্পর্শ থাকে না৷ এই রোগ রোগীর অজান্তেই হয়ে থাকে৷
কারণ:
* কখনো কখনো পারিবারিক ইতিহাস থাকে
* মানসিক চাপের কারণে হতে পারে
* ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন রোগীর ক্ষেত্রে ঘটে
লক্ষণ:
* সাধারণত যুবক বয়সে বেশি দেখা যায়
* ছেলেদের তুলনায় মেয়েদের বেশি হয়
* হাত ও পা শক্ত হয়ে যায়
* মুখ শক্ত হয়ে যায়
* কঁাপুনি থাকতে পারে
* কথা বলতে পারে না
* চোখে অন্ধকার লাগে
* কানে কম শোনে
* কানে ঝিঁ ঝিঁ শব্দ শোনা যায়
* মাঝে মাঝে মাথা ব্যথা হয়
* বমি হতে পারে৷
চিকিৎসা:
দ্রুত মনোরোগ বিশেষজ্ঞের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে৷
পরামর্শ
* রোগীর সঙ্গে আন্তরিকভাবে চলতে হবে৷
* দুশ্চিন্তা-হতাশা কমাতে হবে৷
* ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী চলতে হবে৷
বিষণত্না বা ডিপ্রেশন
বিষণত্না একটি অসুখ যা কখনো কখনো শারীরিক সমস্যার জন্যও হয়ে থাকে আবার কখনো অন্য কোনো কারণেও হয়ে থাকে৷ আত্মহত্যার প্রধান কারণ বিষণত্না৷ বিষণ্নরোগী নেতিবাচক চিন্তায় জড়িয়ে যায়৷ সে নিজেকে সব ধরনের ক্ষেত্রে পরাজিত ভাবে৷ কোনোভাবেই আত্মবিশ্বাস খঁুজে পায় না৷
কারণ
বিষণত্না পারিবারিক বংশপরম্পরায় চলতে পারে৷ মা-বাবা উভয়ে বিষণত্না রোগে ভুগলে সন্তানদের বিষণত্না হবার ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি৷ পুরুষের তুলনায় নারী বেশি পরিমাণ বিষণত্নায় ভোগে৷ নারীদের সামাজিক প্রেক্ষাপটকে এই হারের জন্য দায়ী করা হয়৷ বয়স একটি ফ্যাক্টর৷ বিষণত্নার গড় বয়স ২০-৪০ বছর৷ ইদানীং গবেষণায় দেখা যাচেছ শিশুরাও বিষণত্নায় ভোগে৷ সোস্যাল স্ট্রেস বা কাজের চাপ বিষণত্নার একটি ফ্যাক্টর৷
উপসর্গ
* ওজন কমে যায়
* কাজে উত্সাহ থাকে না
* মন ভালো থাকে না
* অপরাধ বোধ জণ্মায়
* কিছুতে আগ্রহ পায় না
* কোনো কিছুতে আনন্দ পায় না
* ঘুমে সমস্যা হয়
* প্রায় প্রতিদিন ক্লান্তি, অবসাদে ভোগে
* চিন্তা করার সামর্থ্য কমে যায়
* মনোযোগ ধরে রাখতে ব্যর্থ হয়
* প্রায় প্রতিদিন সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগে
* ক্ষুধা কমে যায়
* পেটের সমস্যা দেখা দেয়
* শরীর দুর্বল লাগে
* শরীরের বিভিন্ন অংশে ব্যথা অনুভূত হয়
* আত্মহত্যার প্রবণতা দেখা যায়, বেঁচে থাকার ইচ্ছা কমে যায়৷ শারীরিক সমস্যার জন্য যখন বিষণত্না দেখা দেয় তা বুঝার উপায়:
* বেশি বয়সে বিষণত্না দেখা যায়
* অতীতে কখনো মানসিক কোনো সমস্যা ছিল না
* পারিবারিক কোনো মানসিক সমস্যা নাই৷
করণীয়
বিষণত্না একটি অসুখ এজন্য দেরী না করে চিকিত্সকের পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধ খেতে হবে৷
মাদকাসক্তি
মাদকাসক্তি বা নেশা এমনই জিনিস তা মদ, গঁাজা, বিড়ি, সিগারেট, চরস, তামাক এবং ইদানীংকালের হেরোইন ইত্যাদি যাই হোক তা একবার ধরলে বা তাতে অভ্যস্ত হয়ে পড়লে চট করে ছাড়া মুশকিল হয়ে যায়৷ শেষে এমন একটা সময় আসে যখন মানুষ আর নেশার জিনিস খায় না৷ নেশার জিনিসই মানুষকে খেতে থাকে৷ আর এই সর্বনাশা নেশার খপ্পরে পড়ে সর্বস্ব এমনকি জীবনটা পর্যন্ত হারাতে হয়৷ ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও নেশার হাত থেকে মুক্তি পাওয়া অসম্ভব হয়ে পড়ে৷
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দেওয়া মাদকাসক্তির ব্যাখ্যাটি অনেকটা এরকম –
একজন মাদকাসক্তের মন মাদক গ্রহণের ইচ্ছায় আচ্ছন্ন থাকে৷ মাদক গ্রহণের মাত্রা বাড়ানোর প্রবণতা বাড়তে থাকে দিন দিন৷ ব্যক্তিজীবন ও পারিবারিক সম্পর্ক বিধ্বস্ত হয়ে যায়৷ বাড়তে থাকে সামাজিক সংকটও৷ মাদকের জন্য তীব্র একটি আকা•ক্ষা মাদকসেবীর মস্তিস্কে আসন গেড়ে বসে৷ মাদক গ্রহণের বিশেষ সময়ে, বিশেষ স্থানে গেলে, বিশেষ বন্ধুদের দেখলে এবং সিরিঞ্জ হাতে পেলে মাদক গ্রহণের ইচ্ছেটি মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে৷
মাদকাসক্তির কারণ:
এই দেশের একটা বিরাট জনগোষ্ঠী আজ মাদকদ্রব্যের প্রতি আসক্ত৷ মানুষ কেন মাদকদ্রব্য গ্রহণ করে তার সঠিক ধারণা দেয়া কঠিন৷ এই ব্যাপারে বিভিন্ন সমাজবিজ্ঞানী ও মনোবিজ্ঞানীরা ৫টি বিষয়কে দায়ী করেন সেগুলো হল – সামাজিক শৃঙ্খলার অভাব, বিচু্যত আচরণ, মূল্যবোধ, সংঘাত এবং অতৃপ্তি৷ এই কথা সত্য যে, মানুষের নিজস্ব কর্মকাণ্ডে, যেসব সঙ্গীর সঙ্গে সে মেলামেশা করে এবং যে পরিবেশে সে বসবাস করে সেগুলোই তাকে মাদকদ্রব্যের প্রতি আসক্ত করে৷ তাছাড়া শহর সমাজে পারিবারিক ভাঙন, সমঝোতার অভাব, স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে শিথিল সম্পর্ক এবং হতাশার কারণে মানুষ মাদকের প্রতি আসক্ত হচ্ছে৷ বিদেশী সংস্কৃতির প্রভাব, সন্তানের ওপর মাতা-পিতার উদাসীনতাও ছেলে-মেয়েদের মাদকের প্রতি আসক্ত করে৷
মাদকাসক্তির কারণ অনেক, যেমন –
* মাদকের সহজলভ্যতা (মাদকের কাছে থাকা, সামনে থাকা)
* মাদকাসক্ত সঙ্গীর সঙ্গে মেলামেশা করা কিংবা অতীতের মাদক গ্রহনের স্মৃতি মধ্যে ডুবে থাকা৷
* নেতিবাচক অনুভূতি, যেমন – ক্রোধ, বিষাদ, একাকিত্ব, অপরাধবোধ, ভীতি কিংবা উদ্বেগের জালে সেঁটে থাকা৷
* উত্সব উদযাপনের নামে দু-এক দিনের জন্য মাদক গ্রহণ করা৷
* দৈহিক উপসর্গ, যেমন- ব্যথা, জ্বালা-যন্ত্রনায় ভোগা৷
* হঠাত্ হাতে প্রচুর টাকা-পয়সা চলে আসা৷
* মাদকাসক্তির চিকিত্সা শেষে পুরো ভালো হয়ে গেছি, এখন এক-দুবার মাদক নিলে এমন আর কি হবে – এ ধরনের আত্মবিশ্বাসের ফাঁদে পা দেওয়া৷
কীভাবে বুঝবেন কেউ নেশা করছে
অধিকাংশ সময়ই বাবা-মা বুঝতে পারেন না তাদের সন্তান কখন কী অবস্থায় মাদকনির্ভর হয়ে যাচ্ছে৷ একেবারে শেষ পর্যায়ে যখন তীব্র শারীরিক লক্ষণ দেখা দেয় তখনই কেবল বুঝতে পারেন৷ অথচ একটু সচেতনভাবে লক্ষ্য রাখলেই বাবা-মা বা পরিবারের লোকজন প্রাথমিক অবস্থায়ই বুঝে ফেলতে পারবেন তাদের সন্তান নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়ছে কি না? মাদকনির্ভরতার লক্ষণ এবং নমুনাগুলো যদি প্রাথমিকভাবে ধরে ফেলা যায় তাহলে খুব সহজেই সন্তানকে স্নেহ ভালোবাসা এবং প্রয়োজনীয় চিকিত্সা ও পরিচর্যা দিয়ে সুস্থ করে তোলা যায়৷
পরিবারের কোনো সদস্য মাদকদ্রব্য গ্রহণ শুরু করছে কি না তা বোঝার জন্য কতগুলো আচরণগত পরিবর্তন খেয়াল করলেই বোঝা যাবে, যেমন –
* হঠাৎ করেই স্বাভাবিক আচরণ পরিবর্তন আসতে পারে৷ অন্যমনস্ক থাকা, একা থাকতে পছন্দ করা৷
* অস্থিরতা প্রকাশ, চিৎকার, চেঁচামেচি করা৷
* অসময়ে ঘুমানো, ঝিমানো কিংবা হঠাৎ চুপ হয়ে যাওয়া৷
* কারণে-অকারণে মন খারাপ ব্যবহার করা এবং অসংলগ্ন ও অস্পষ্ট কথাবার্তা বলা৷
* কোথায় যায়, কার সঙ্গে থাকে – এসব বিষয়ে জানতে চাইলে বিরক্ত হওয়া, গোপন করা কিংবা মিথ্যা বলা৷
* ঘর অন্ধকার করে জোরে মিউজিক শোনা৷
* নির্জন স্থানে বিশেষত বাথরুম বা টয়লেটে আগের চেয়ে বেশি সময় কাটানো৷
* রাত করে বাড়ি ফেরা, রাতজাগা, দেরিতে ঘুম থেকে ওঠা৷
* হঠাৎ নতুন অপরিচিত বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে বেশি মেলামেশা করা৷
* বিভিন্ন অজুহাতে ঘন ঘন টাকা-পয়সা চাওয়া৷
* স্বাভাবিক খাবার-দাওয়া কমিয়ে দেওয়া৷
* অভিভাবক এবং পরিচিতদের এড়িয়ে চলা৷
* স্বাভাবিক বিনোদন মাধ্যমে ক্রমশ আগ্রহ হারিয়ে ফেলা৷
* বাড়ির বিভিন্ন জায়গা থেকে ক্রমাগত টাকা-পয়সা ও মূল্যবান জিনিসপত্র হারিয়ে যাওয়া৷
* ঋণ করার প্রবণতা বেড়ে যাওয়া৷
মাদকাসক্তির চিকিত্সা ও পুনর্বাসন
যদি আপনার সন্তান বা পরিচিতজন অতিমাত্রায় মাদকনির্ভর হয়ে পড়ে এবং পারিবারিকভাবে তাকে আর কোনোমতেই নিয়ন্ত্রণ করা না যায়, তবে তার চিকিত্সার জন্য বিশেষজ্ঞ চিকিত্সকদের শরণাপন্ন হোন৷ সামাজিক দুর্নাম কিংবা সম্মানহানির গ্লানিতে না ভুগে হাসপাতাল কিংবা ক্লিনিকে চিকিত্সাধীন রাখুন৷ একটা কথা মনে রাখতে হবে, নেশা ছাড়ার জন্য সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন, মানসিক জোর৷ মন থেকে নেশার জন্য গভীর অনুতাপ ও অনুশোচনা এবং নেশা করার জন্য নিজের ওপর বাস্তবিক ধিক্কার না এলে কিন্তু শত ওষুধেও বা হাজার পরামর্শেও নেশা ছাড়া সম্ভব হবে না৷
দমিয়ে রাখুন মাদক গ্রহণের ইচ্ছে
* যে প্রেক্ষাপটগুলো মাদক গ্রহণের তীব্র ইচ্ছেটি জাগিয়ে তোলে, ধীরে ধীরে সেগুলোর মুখোমুখি হতে হবে৷ সুষ্ঠ পরিকল্পনা নিয়ে অগ্রসর হলে ধীরে ধীরে ইচ্ছেটির তীব্রতা কমানো যায়৷
* নিজেকে বিনোদনমূলক, সৃজনশীল কিংবা উত্পাদনশীল কাজে নিয়োজিত করে এক্ষেত্রে সফলতা পাওয়া যায়৷
* নিজেকে নিয়ন্ত্রণ কিংবা শাসনের যথাযথ শক্তি ধীরে ধীরে অর্জিত হয়৷ এ সময় প্রয়োজন বন্ধু ও পরিবারের সমর্থন এবং পরামর্শ৷
প্রয়োজন বন্ধু ও পরিবারের সমর্থন
মাদকাসক্ত ব্যক্তি মাদকাসক্তিকে কীভাবে মোকাবিলা করবে তা বুঝে উঠতে পারে না তারা৷ এ ক্ষেত্রে প্রথম বাধা হচ্ছে পরিবারের সদস্যদের সন্দেহ ও অবিশ্বাস৷ পরিবারের সদস্যদের মাদকাসক্তি থেকে সেরে ওঠতে থাকা ব্যক্তির ভালো কাজের প্রশংসা করতে হবে৷মাদকাসক্ত ব্যক্তিকে মতামত প্রকাশের সুযোগ দিতে হবে৷ আলাপচারিতার পরিবেশ সহজ রাখতে হবে৷ কোনো ভালো কাজের দায়িত্ব তাকে দিতে হবে৷ মন খুলে তার কাজের স্বীকৃতি দিতে হবে৷ এ অবস্থায় তার সঠিক খাবারের প্রতি নজর দিতে হবে৷ সুষম খাবার, পানি এবং মনোচিকিত্সকের পরামর্শমতো নিয়মিত ওষুধ সেবনের ব্যাপারে খেয়াল রাখতে হবে৷ কিছু কিছু ক্ষেত্রে দৃঢ় মনোভাবের পরিচয় দিতে হবে৷ তার ব্যক্তিগত দাবি পূরণের ব্যাপারে সংযত হতে হবে৷ তার হাতে যেন টাকা-পয়সা সহজে চলে না আসে, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে৷