ভিটামিন ‘এ’ একটি ফ্যাট বার্ণিং ভিটামিন যা আমাদের শরীরের গ্রোথ, চোখের দৃষ্টি, প্রজনন স্বাস্থ্য এবং শরীরের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা উন্নত করে। আমরা প্রায় সকলেই জানি ভিটামিন ‘এ’ কি এবং কেন আমাদের যথেষ্ট্য পরিমাণ ভিটামিন ‘এ’ প্রয়োজন। এবার, সবচেয়ে বেশি ভিটামিন ‘এ’ আছে যেসব খাবারে সেগুলো সম্পর্কে আমাদের প্রত্যেকেরই জেনে রাখা উচিৎ।
দৈনন্দিন খাবার থেকে আমরা যদি যথেষ্ট পরিমাণ ভিটামিন ‘এ’ পাই, তবে এটি আমাদের বিভিন্ন ধরণের চর্ম রোগ, চোখের শুস্কতা, অকাল অন্ধত্ব, এমনকি চুল পড়া প্রতিরোধে দারুণ ভূমিকা পালন করে। চোখসহ আমাদের শরীরের নানা অঙ্গের সঠিক সুস্থ্যতার জন্যে ভিটামিন ‘এ’ এর প্রয়োজনীতা অনস্বীকার্য।
অনুন্নত এবং উন্নয়নশীল দেশে ভিটামিন ‘এ’ এর অভাবে অন্ধত্বসহ নানা রকম রোগের জন্ম দিচ্ছে। অন্যদিকে, উন্নত দেশের মানুষেরা প্রাকৃতিক খাদ্য থেকে যথেষ্ট্য পরিমাণ ভিটামিন ‘এ’ গ্রহণ করে থাকে। ফলে, ওই সব দেশের লোকেরা রাতকানাসহ অন্যান্য নানা রোগ থেকে মুক্ত থাকে।
যথেষ্ট্য পরিমাণ ভিটামিন ‘এ’ এর অভাবে যকৃৎ, মুখ গহবর এবং আরো কিছু শারীরিক অঙ্গ ক্ষতির মুখে পড়ে যায়। মায়েদের জন্যে এটি আরো বেশি প্রয়োজনীয়। কারণ, সন্তান গর্ভে থাকা অবস্থায় মা যদি যথেষ্ট্য পরিমাণ ভিটামিন এ গ্রহণ না করে, তবে তার গর্ভের সন্তান অন্ধত্ব নিয়ে জন্মাতে পারে, এমনকি হতে পারে বিকলাঙ্গও। জেনে নিন ভিটামিন ‘এ’ এর অভাবে আরো যে সমস্ত রোগ হয়।
তবে ভিটামিন ‘এ’ এর জন্যে সাপ্লিমেন্টের উপর নির্ভরশীল না হয়ে খাবারের প্রতি মনোযোগী হওয়া উত্তম বলে মত দিয়েছেন চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা। তাই, যে-সব খাবারে সবচেয়ে বেশি পরিমাণে ভিটামিন এ আছে, সেগুলো সম্পর্কে জানুন আর খাবারের তালিকায় সেগুলোকে নিয়মিত রাখুন।
ভিটামিন ‘এ’ আছে যেসব খাবারে
শাক-সবজি থেকে শুরু করে, মাছ মাংশ এবং ফলমূলের মধ্যে যেগুলোতে বেশি পরিমাণে ভিটামিন এ পাওয়া যায়, নিচে সেগুলো সম্পর্কে আলোচনা করা হলো।
গাজরে আছে প্রচুর ভিটামিন ‘এ’
একটি বড় গাজরে ১২ হাজার ২৮ আইইউ (ইন্টারন্যাশনাল ইউনিট) পরিমাণ ভিটামিন এ রয়েছে। যেখানে একটা মানুষের জন্যে দৈনিক ৫ হাজার আইইউ পরিমাণ ভিটামিন প্রয়োজন, সেখানে একটা গাজরেই রয়েছে তার দ্বিগুণ।
গাজর থেকে আমরা যে বেটা ক্যারোটিন গ্রহণ করে থাকি, তা আমাদের শরীরে গিয়ে ভিটামিন এ তে কনভার্ট হয় বলে জানিয়েছেন ইন্টারন্যাশনাল হেলথ্ অর্গানাইজেশনের চেয়ারম্যান, ক্যাডি ব্রাউন।
গাজর কমলা রঙের একটি সাধারণ সবজি যা আমাদের দেশে শীতকালে বেশি পাওয়া যায়। শীতের আগে এবং পরেও আমাদের দেশের বাজারগুলোতে গাজরের দেখা মেলে।
পালং শাকে ভিটামিন ‘এ’ আছে প্রচুর পরিমাণে
আপনি কি পালং শাকের সালাদ পছন্দ করেন কিংবা মাছ দিয়ে পালং শাক রান্না খেতে ভালবাসেন? যদি তাই হয়, তবে আপনি যথেষ্ট্য ভাগ্যবান। কারণ, আপনার শরীর আপনার অজান্তেই প্রচুর ভিটামিন এ পাচ্ছে এবং নানা রকম রোগ থেকে মুক্ত রয়েছে।
পালং শাকে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন এ ছাড়াও রয়েছে ভিটামিন সি, আয়রন ও ভিটা ক্যারোটিন। এমনকি রয়েছে প্রচুর ম্যাগনেসিয়াম যা হাই ব্লাড প্রেশার রোগীদের জন্যে আর্শীবাদস্বরূপ।
পালং শাকে থাকা ভিটামিন এ রক্তের শ্বেত কণিকা বা লিম্পোসাইটকে সর্বদা সুস্থ্য থাকতে সাহায্য করে। এমনকি, আপনার ত্বকের বাইরের আদ্রতা বজায় রাখে পালং শাকের ভিটামিন এ।
এছাড়াও, পালং শাকে রয়েছে নানা রকমের ফ্ল্যাভোনয়েড যা মানুষের শরীরে লুকিয়ে থাকা ক্যান্সারের বিরুদ্ধে কার্য্যকর ভূমিকা পালন করে। এতে থাকা উচ্চ মাত্রার ভিটা ক্যারোটিন আমাদেরকে নানা রকম চোখের রোগ থেকে রক্ষা করে, বিশেষ করে চোখের ছানি পড়া প্রতিরোধ করে।
এক কাপ পরিমাণ পালং শাকে ভিটামিন এ এর পরিমাণ ২৮১৩ আইইউ।
মিষ্টি আলু ভিটামিন ‘এ’ এর বিশাল ভান্ডার
একটি মাঝারি সাইজের মিষ্টি আলুতে ভিটামিন এ এর পরিমাণ ২১৪% ডিভি। শুধু ভিটামিন এ’ই নয়, মিষ্টি আলুতে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন সি এবং বিটা-ক্যারোটিন যা শরীরের বলিরেখা দূর করে এবং শরীরের রক্ত পরিশোধন করে।
মিষ্টি আলুতে প্রচুর পটাশিয়াম থাকায় এটি হার্টের রোগীদের জন্যে সাহায্যকারী হিসেবে বিবেচিত। এছাড়াও, এটি শরীরের ইমিউন সিস্টেমের জন্যে উপকারি, যে কোন ধরণের প্রদাহ প্রতিরোধে কার্য্যকর, অ্যাজমা নিরাময়েও ভূমিকা রাখে।
ভিটামিন ‘এ’ এর বড় উৎস মিষ্টি কুমড়া
ভিটামিন এ এর সবচেয়ে বড় উৎস যে মিষ্টি কুমড়া, এটা আমরা প্রায় সকলেই জানি। বিটা ক্যারোটিনযুক্ত মিষ্টি কুমড়ায় রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন এ যা প্রায় সব ধরণের চোখের রোগের জন্যে মহৌষধ হিসেবে কাজ করে।
বিশেষ করে বয়সের ভারে যে-সব চক্ষু রোগ হয়, সে সব রোগের জন্যে মিষ্টি কুমড়া দারুণ উপকারি।
মানুষের শরীরের প্রায় ১৭০ ভাগ ভিটামিন “এ” এর অভাব অনায়াসে পূরণ হয়ে যায় মাত্র ১০০ গ্রাম মিষ্টি কুমড়া খাওয়ার মাধ্যমে। ভিটামিন এ এর পাশাপাশি মিষ্টি কুমড়াতে রয়েছে শক্তিশালি অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট বিটা ক্যারোটিন, ভিটামিন সি, পটাশিয়াম ও ম্যাগনেশিয়াম।
মিষ্টি কুমড়াকে আমাদের দেশে অনেকে মিষ্টি লাউও বলে থাকেন। আর এটি পৃথিবীর অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশেই সবচেয়ে বেশি হয়ে থাকে। বাইরের দেশের মানুষ মিষ্টি কুমড়াকে সাধারণ সালাদের সঙ্গে খেয়ে থাকলেও, আমাদের দেশের মানুষ এটিকে তরকারি হিসেবে খেতেই বেশি পছন্দ করে থাকে।
জাম্বুরায় ভিটামিন ‘এ’ আছে
জাম্বুরা নামক সিজনাল এই ফলটিতে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন এ যা নানা রকম রোগ থেকে মানুষের দেহকে সুরক্ষা দিয়ে থাকে। তবে, জাম্বরায় ভিটামিন এ এর চেয়ে ভিটামিন সি থাকে বেশি। একটি গোলাপী কিংবা লাল রঙের জাম্বুরাতে ভিটামিন “এ” এর পরিমাণ ২৮৩০ আইইউ আর ভিটামিন সি এর পরিমাণ ৩১.২ মিলিগ্রাম।
এছাড়াও একটি মাঝারি সাইজের জাম্বুরাতে রয়েছে ১৩৫ মিলিগ্রাম পটাশিয়াম, ১১ মিলিগ্রাম কার্বোহাইড্রেট, ১.৬ গ্রাম ডায়েট্রারি ফাইবার, ৫% ভিটামিন বি-৬ এবং ২% ম্যাগনেশিয়াম।
১০০ গ্রাম কলিজায় ৬৫০০ আইইউ ভিটামিন ‘এ’
কলিজাতে (সেটা যে প্রাণীর কলিজাই হোক) অনেক বেশি পরিমাণে ভিটামিন “এ” থাকে। প্রায় ৬৫০০ আইইউ ভিটামিন “এ” পাওয়া যায় ১০০ গ্রাম গরুর কলিজায়।অন্যদিকে প্রতি ১০০ গ্রাম ছাগলের কলিজায় ভিটামিন এ রয়েছে ৫৭০০ আইইউ। আর ১০০ গ্রাম মুরগির কলিজায় ভিটামিন “এ” এর পরিমাণ আরো বেশি।
সুতরাং, পর্যাপ্ত পরিমাণ ভিটামিন “এ” পাওয়ার জন্যে খেতে পারেন ভিবিন্ন ধরণের প্রাণীর কলিজা। কলিজায় শুধু ভিটামিন এ’ই নয়, রয়েছে প্রচুর পরিমাণে আয়রণ।
এক কাপ দুধে ভিটামিন ‘এ’ আছে ১১২ মাইক্রোগ্রাম
সন্তানের সুস্বাস্থ্যের জন্যে আপনি যখন তাকে প্রতিদিন এক গ্লাস দুধ খেতে দেন, তখন হয়তো নিজেও এক কাপ দুধ খেয়ে নেন। যদি তাই হয়, তবে তো আপনি সন্তানের শরীরের পাশাপাশি নিজের শরীরকেও দিচ্ছেন ভিটামিন ‘এ’ এর যোগান।
গরুর দুধ হোক আর ছাগলের দুধ, যে কোনও দুধেই রয়েছে যথেষ্ট্য পরিমাণে ভিটামিন ‘এ’। এক কাপ দুধ আপনার শরীরকে ১১২ মাইক্রোগ্রাম ভিটামিন ‘এ’ এর যোগান দেয়। সুতরাং শরীরকে সুস্থ্য রাখতে সুস্বাধু এই খাবারটি নিয়মিত খান এবং পরিবারের সকলকে খাওয়ান।
মাখনে পর্যাপ্ত ভিটামিন ‘এ’ আছে
আমরা জানি, দুধের ক্রিম থেকে মাখন তৈরি হয় আর এটি ভিবিন্ন খাবারে মাখা হয় খাবারকে সুস্বাধু করতে। অনেক সময় নানা রকম খাবারে এটি মাখা হয় সুঘ্রাণের জন্যে। আপনি হয়তো নিজের অজান্তেই বিভিন্ন খাবারের সঙ্গে নিয়মিত মাখন খেয়ে চলেছেন যা আপনার শরীরকে দিচ্ছে পর্যাপ্ত ভিটামিন এ।
মাখন সাধারণত খাবারের সঙ্গে মেখে খাওয়া হলেও সবচেয়ে ভাল হয় সকালের নাস্তায়। হতে পারে রুটির সঙ্গে মেখে কিংবা অন্য যে কোন সুবিধাজনক উপায়ে।
কড লিভার অয়েলে প্রচুর ভিটামিন ‘এ’
কড মাছের তেল দিয়ে তৈরি ক্যাপসুল দেখেছেন নিশ্চয়ই? কড মাছের লিভার থেকে সংগ্রহ করা হয় এ ধরণের তেল। হ্যাঁ, এ ক্যাপসুল মূলত ভিটামিন ‘এ’ দিয়ে ভরপুর থাকে। আর এই ক্যাপসুল ব্যবহার করা হয় মূলত ওষুধ হিসেবে।
পর্যাপ্ত পরিমাণে ভিটামিন ‘এ’ এর জন্যে খেতে পারেন এই ক্যাপসুল। এক’শ গ্রামে আছে ত্রিশ হাজার আইইউ।
বিভিন্ন ধরণের ডিমে ভিটামিন ‘এ’ আছে
হাসের ডিম হোক আর মুরগির ডিম হোক কিংবা কোয়েল পাখির ডিমই হোক না কেন, সব ধরণের ডিমেই থাকে প্রায় সব ধরণের ভিটামিন। তবে, ভিটামিন ‘এ’ এর একটি বড় উৎস হিসেবেই বিবেচনা করা হয় ডিমকে। কাজেই, প্রতিদিন ডিম খেতে পারেন পর্যাপ্ত ভিটামিন ‘এ’ পেতে।
১০০ গ্রাম আমে ৫৪ আইইউ ভিটামিন ‘এ’
আমাদের দেশ আমের জন্যে বিখ্যাত আর আম বিখ্যাত ভিটামিন ‘এ’ এর জন্যে। প্রতি একশ গ্রাম আমে আছে (হোক সেটা লেংড়া, হিমসাগর কিংবা যে কোন জাতের আম) চুয়ান্ন আইইউ ‘এ’ ভিটামিন।
কাজেই, আমের সিজনে প্রচুর পরিমাণে আম খেয়ে নিতে পারেন যা আপনাকে সারা বছরই সুস্থ্য রাখবে, রাখবে ভিটামিন ‘এ’ এর অভাবমুক্ত।
১০০ গ্রাম টমেটোতে ৪২ আইইউ
আপনি হয়তো টমেটো খুব পছন্দ করেন। রান্নার সাথে খাওয়ার পাশাপাশি সালাদ হিসেবেও অনেক সময় প্রচুর টমেটো খেয়ে থাকেন। যদি তাই হয়, তবে আপনার ভিটামিন ‘এ’ এর অভাব হওয়ার কথাই না। কারণ, টমেটোতে রয়েছে যথেষ্ট্য পরিমাণে ভিটামিন এ, যেমন একশ গ্রামে থাকে বেয়াল্লিশ আইইউ।
শীতকালে আমাদের পছন্দের এই সবজিটি সবচেয়ে বেশি পাওয়া যায়। তাই, এ সময় সালাদের সাথে কিংবা তরকারির সাথে প্রচুর পরিমাণে টমেটো খেয়ে নিতে পারেন।
বিভিন্ন ধরণের শাকে আছে প্রচুর ভিটামিন ‘এ’
পালং শাকের কথা উপরে উল্লেখ করা হলেও আরো অনেক শাক রয়েছে যেগুলোতে আপনি যথেষ্ট্য পরিমাণে ভিটামিন এ পাবেন। কাজেই, সব সময় সব ধরণের শাক খাবেন।
শেষ কথা
যেহেতু আপনি আজ জেনে গেলেন ভিটামিন ‘এ’ আছে যেসব খাবারে সেগুলো সম্পর্কে বিস্তারিত, সেহেতু ভিটামিন ‘এ’ এর অভাবজণিত রোগগুলো থেকে মুক্ত থাকতে এসব খাবার বেশি বেশি খাবেন। সেই সাথে পরিবারের অন্যান্য সদস্যদেরও এ জাতীয় খাবারগুলো অধিক পরিমাণে খাওয়ার জন্যে উৎসাহিত করবেন। বিশেষ করে, পরিবারের ছোট সদস্যদেরকে ভিটামিন এ যুক্ত খাবার খেতে ব্যাপকভাবে উৎসাহিত করা আপনার কর্তব্য।