পরিবার পরিকল্পনার আধুনিক পদ্ধতিসমূহ

পরিকল্পিত ও সুস্থ-সুন্দর পরিবার গড়ে তোলার জন্য প্রতিটি দম্পতিকেই পরিবার পরিকল্পনার পদ্ধতি সম্পর্কে সকল তথ্য জানতে হবে এবং ভেবে-চিন্তে উপযুক্ত পদ্ধতিটি বেছে নিতে হবে।

অস্থায়ী পদ্ধতি (স্বল্পমেয়াদী): ১. খাবার বড়ি/Oral Pill (মহিলাদের জন্য)
২. কনডম/Condom (পুরুষদের জন্য)
৩. ইনজেকটেবলস্/Injectables (৩ মাস মেয়াদী মহিলাদের জন্য)
অস্থায়ী পদ্ধতি (দীর্ঘমেয়াদী): ১. আই ইউ ডি/IUD (১০ বছর মেয়াদী মহিলাদের জন্য)
২. ইমপ্লান্ট/Implant (৩/৫ বছর মেয়াদী মহিলাদের জন্য)
স্থায়ী পদ্ধতিঃ ১. ভ্যাসেকটমি/এনএসভি (NSV) -ছুরিবিহীন ভ্যাসেকটমী (পুরুষদের জন্য)
২. টিউবেকটমি (Tubectomy) /লাইগেশন (মহিলাদের জন্য )

খাবার বড়ি (Oral Pill)

গর্ভনিরোধের মিশ্র খাবার বড়ি সাধারণ মানুষের কাছে ‘খাবার বড়ি’ হিসেবেই পরিচিত। খাবার বড়ি গর্ভনিরোধের অত্যন্ত নিরাপদ ও কার্যকর পদ্ধতি। বাংলাদেশে খাবার বড়িই হলো সর্বাধিক ব্যবহৃত জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি। বর্তমানে প্রচলিত খাবার বড়ির উপাদান হলো এষ্ট্রোজেন ও প্রজেষ্টেরন হরমোন। মূলতঃ এষ্ট্রোজেন হরমোন এর পরিমাণের উপর ভিত্তি করে খাবার বড়ির প্রকার নির্ণয় করা হয়। এ জন্য খাবার বড়িকে মিশ্র খাবার বড়ি নামে অভিহিত করা হয়।

কার্যকারিতাঃ

মিশ্র বড়ি সঠিকভাবে গ্রহণ করলে প্রায় ৯৯.৯ শতাংশ কার্যকরী।

খাবার বড়ির সুবিধাঃ

অসুবিধাসমূহঃ

খাবার বড়ি যাদের জন্য উপযুক্ত

যারা জন্মনিয়ন্ত্রণে অত্যন্ত কার্যকরী একটি অস্থায়ী পদ্ধতি নিতে চান।

খাবার বড়ি যাদের জন্য উপযুক্ত নয়

বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে প্রস্ত্ততকৃত খাবার বড়ি ব্যবহারে বিবেচ্য স্বাস্থ্যগত ও সামাজিক উপযুক্ততার নির্দেশিকা অনুযায়ী সে সব স্বাস্থ্যগত ও সামাজিক অবস্থায় খাবার বড়ি প্রদান করা যাবে না তা নিম্নে বর্ণনা করা হলো

খাবার বড়ির ব্যবহার বিধি

বাংলাদেশে প্রায় সকল মিশ্র খাবার বড়ি প্যাকেটে ২১টি সাদা গর্ভনিরোধক বড়ি (যার প্রধান উপাদান হরমোন) এবং ৭টি খয়েরি বড়ি (আয়রন বড়ি) থাকে। কোন কোন প্যাকেটে বা পাতায় শুধু মাত্র ২১টি জন্মনিরোধক বড়ি থাকে।

খাবার বড়ি প্রথম শুরু করার নিয়ম

যদি বড়ি খাওয়া বাদ পড়ে তাহলে কি করণীয়

কনডম (Condom)

কনডম পুরুষদের জন্য একটি নিরাপদ এবং কার্যকর জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি। শুধুমাত্র জন্ম নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি হিসাবে নয়, কনডম যৌনবাহিত সংক্রমণের বিস্তার রোধ করতে পারে। কনডম বহু নামে এবং বিভিন্ন রং, আকার ও আকৃতিতে পাওয়া যায়। এর ব্যবহার অনাকাংখিত গর্ভধারণ প্রতিরোধ করে এবং যৌনবাহিত রোগের বিস্তার রোধ করে। বাংলাদেশে গড়ে ৪.৫ % পুরুষ এই পদ্ধতি ব্যবহার করেন।

কনডম কী?

কনডম রাবার বা ল্যাটেক্সের তৈরী একটি পাতলা আচ্ছাদন যা যৌনসঙ্গমের সময়ে পুরুষ ও নারীর যৌনাঙ্গের মধ্যে একটি প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করে। গ্রহণযোগ্যতার জন্য কনডম খুবই পাতলাভাবে তৈরী হয়। এতে শুক্রনাশক ও পিচ্ছিলকারক পদার্থও এখন যোগ করা হচ্ছে। বর্তমানে কিছু কনডম ফোঁটাযুক্ত (dotted) হওয়াতে এর গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে কনডম এখন আরও বেশি স্বাচ্ছন্দ্যকর পদ্ধতি হিসাবে ব্যবহৃত হচ্ছে।

গর্ভ প্রতিরোধে কনডম কিভাবে কাজ করে

কনডম একটি প্রতি বন্ধক বস্ত্ত (Physical barrier) হিসাবে কাজ করে। বীর্যপাতের পর শুক্রকীট কনডমের ভিতরেই থেকে যায় ফলে কনডম শুক্রকীটকে যোনিপথে ঢুকতে বাঁধা দেয়। যার কারণে শুক্রানু ডিম্বানুর সাথে মিলতে পারে না, ফলে গর্ভসঞ্চার হয় না। কনডমের সঠিক ব্যবহার জন্মনিয়ন্ত্রণ ও যৌনবাহিত রোগের বিস্তার রোধ করে। তবে কনডমের ভূল ব্যবহার ও ফেটে গেলে গর্ভধারণের সম্ভাবনা থাকে।

কনডমের কার্যকারীতা

সঠিক নিয়মে ব্যবহার করলে কনডম খুবই কার্যকর একটি জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি। সঠিক নিয়মে ব্যবহার করলে ব্যর্থতার হার শতকরা মাত্র ২ ভাগ। যদি সঠিকভাবে ব্যবহার করা না হয়ে থাকে তবে জন্মনিয়ন্ত্রণ ও যৌনরোগ (STDs) প্রতিরোধে কনডমের কার্যকারীতা অনেক হ্রাস পায়। কনডম সঠিক নিয়মে ব্যবহারের মাধ্যমে এইচআইভি/এইডস, গণোরিয়া, সিফিলিস, ক্ল্যামাইডিয়া, ট্রাইকোমোনিয়াসিস রোগ হতে নিশ্চিত রক্ষা পাওয়া যায়। এছাড়াও হারপিস, জেনিটাল ওয়ার্টস এবং অন্যান্য যৌন রোগ হতে কনডম সুরক্ষা দেয়।

কনডম ব্যবহারে সুবিধাসমূহ

কনডম ব্যবহারে অসুবিধাসমূহ

কনডম কারা ব্যবহার করবেন না

শুধুমাত্র যাদের কনডমে এলার্জি আছে তারা ব্যতীত সকলেই কনডম ব্যবহার করতে পারেন। শুধুমাত্র এলার্জি না থাকলে নিরাপদে ও কার্যকরভাবে কনডম ব্যবহার করা যায়। ল্যাটেক্সে এলার্জির কিছু লক্ষণঃ পুরুষাঙ্গ লাল হয়ে যাওয়া, ফুলে যাওয়া বা চুলকানী।

কনডম কারা ব্যবহার করবেন

কনডমের ব্যবহারবিধি

কনডম কিভাবে সংরক্ষণ করবেন

গর্ভ নিরোধক ইনজেকশন (Injectables)

গর্ভ নিরোধক ইনজেকশন মহিলাদের জন্য একটি নিরাপদ ও কার্যকর গর্ভনিরোধক অস্থায়ী পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতি। বাংলাদেশে পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচীতে শুধুমাত্র প্রজেস্ট্রেরন সমৃদ্ধ গর্ভ নিরোধক ইনজেকশন প্রচলিত আছে। বাংলাদেশে গড়ে ১০ % মহিলা এই পদ্ধতি ব্যবহার করেন।

গর্ভনিরোধক ইনজেকশন কী ?

গর্ভনিরোধক ইনজেকশন মহিলাদের জন্য অস্থায়ী ও স্বল্পমেয়াদী পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতি। যা তিনমাস অন্তর অন্তর গভীর মাংসপেশীতে নিতে হয়।

 কার্যকারিতা

১৫০ মিলিগ্রাম একটি ইনজেকশন প্রতি ৩ মাস পর পর দেখা গেছে প্রতি ১০০ জন মহিলার ক্ষেত্রে বছরে পদ্ধতি ব্যর্থতার হার শতকরা ০.৩ জনেরও কম।

ইনজেকশন ব্যবহারে সুবিধা

ইনজেকশন ব্যবহারে অসুবিধা

ইনজেকশন যাদের জন্য উপযুক্ত

যাদের ইনজেশন দেয়া যাবে না

সামাজিক কারণ
স্বাস্থ্যগত কারণ

ইনজেকশন দেওয়ার উপযুক্ত সময়/প্রয়োগবিধি

মাসিকের পর
পরবর্তী ডোজের জন্য গ্রহীতার জন্য পরামর্শ

ইনজেকশন ৩ মাস পর পর   নিতে হবে (১ম ডোজ ক্লিনিকে পরিবার কল্যাণ পরিদর্শিকার দ্বারা)। যদি কোন কারণে নির্ধারিত তারিখের মধ্যে ইনজেকশন না নিতে পারে তাহলে যৌন সঙ্গম থেকে বিরত থাকতে হবে বা কনডম ব্যবহার করতে হবে এবং যত তাড়াতাড়ি সম্ভব স্থানীয় পরিবার কল্যাণ সহকারীর সঙ্গে বা ক্লিনিকে যোগাযোগ করতে হবে। পরিবার কল্যাণ সহকারীগণ ইনজেকশন এর ২য় ও তৎপরবর্তী ডোজসমূহ দিয়ে থাকেন।

ইনজেকশনের পার্শ্ব প্রতিক্রিয়াসমূহ

আই ইউ ডি (IUD)

আইইউডি মহিলাদের জরায়ুতে স্থাপন উপযোগী একটি দীর্ঘ মেয়াদী অস্থায়ী জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি বাংলাদেশে সরকারী কার্যক্রমে ব্যবহৃত আইইউডি’র নাম কপার-টি ৩৮০-এ। সঠিক নিয়মে ব্যবহার করলে এটি অত্যন্ত কার্যকর (৯৯.৯৯%)।

আই ইউ ডি/কপার-টি কী?

ইংরেজি T অক্ষরের মত দেখতে এ পদ্ধতি পলিইথিলিন এর তৈরী, এর দন্ডে এবং দুই বাহুতে তামার সূক্ষ্ম তার জড়ানো থাকে। প্রতিটি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র এবং মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্রে, প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত প্যারামেডিক দ্বারা মেয়েদের জরায়ুতে ইহা পরানো হয়।

আইইউডি’র সুবিধা

আইইউডি’র অসুবিধা

আইইউডি কার জন্য উপযোগী

আইইউডি প্রয়োগের সময়

আইইউডি প্রদানে স্বাস্থ্যগত ও সামাজিক উপযুক্ততা

নিম্নলিখিত কারণে আই ইউডি পরানো যাবে না

ইমপ্ল্যান্ট (Implant)

ইমপ্ল্যান্ট একটি দীর্ঘ মেয়াদী, শুধুমাত্র প্রজেষ্টোজেন হরমোন সমৃদ্ধ কার্যকর গর্ভনিরোধক যা মহিলাদের বাহুতে চামড়ার নিচে স্থাপন করা হয়। বাংলাদেশে বর্তমানে ইমপ্ল্যানন (এক রড বিশিষ্ট) তিন বছর মেয়াদী ইমপ্ল্যান্ট ব্যবহার করা হয় এবং পাঁচ বছর মেয়াদী দুই রড বিশিষ্ট ইমপ্ল্যান্ট কর্মসূচীতে অন্তর্ভূক্তির সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।

ইমপ্ল্যান্ট কী?

ইমপ্ল্যান্ট ১/২ রড বিশিষ্ট ছোট ছোট নরম চিকন ক্যাপসুল যা একজন মহিলার বাহুর ভিতরের দিকে ত্বকের নীচে স্থাপন করা হয়।

কার্যকারিতা

ইমপ্ল্যান্ট ব্যবহারকালীন প্রথম বছর প্রতি ১০০০ জনে ১ জন মহিলা গর্ভধারনের ইতিহাস পাওয়া যায়।

ইমপ্ল্যান্টের সুবিধা

ইমপ্ল্যান্টের অসুবিধা

ইমপ্ল্যান্টের জন্য উপযুক্ত গ্রহীতা

ইমপ্ল্যান্ট স্থাপনের উপযুক্ত সময়

মহিলাদের স্থায়ী পদ্ধতি

টিউবেকটমি (Tubectomy)/লাইগেশন

যেসব মহিলার কমপক্ষে দুটি জীবিত সন্তান রয়েছে ও ছোট সন্তানের বয়স কমপক্ষে ১ বছর হয়েছে এবং ভবিষ্যতে নিশ্চিতভাবে আর কোন সন্তান নিতে চান না তাদের জন্য টিউবেকটমি একটি নিরাপদ ও কার্যকরী জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি।

টিউবেকটমি অপারেশন দুই পদ্ধতিতে করা হয়

১. মিনিল্যাপ টিউবেকটমি (Minilap Tubectomy): এ পদ্ধতিতে মহিলাদের তলপেটের নিম্নাংশে মিনিল্যাপারটমির (সামান্য কেটে) মাধ্যমে পেটের ভিতরে আংগুল ঢুকিয়ে ডিম্ববাহী নালী উপরে তুলে আনতে হয় এবং ডিম্ববাহী নালীর কিছু অংশ বেধে কেটে ফেলে দেওয়া হয়, ফলে নালীপথের ধারাবাহিকতা বন্ধ হয়ে যায়। বাংলাদেশে এই পদ্ধতিতে টিউবেকটমি করা হয় এবং ব্যর্থতার হার খুবই কম।

২. ল্যাপারোস্কোপির মাধ্যমে টিউবেকটমি (Laparoscopic Tubectomy): ল্যাপারোস্কোপির মাধ্যমে ডিম্ববাহী নালীতে স্প্রিং-ক্লিপ বা ফেলপ-রিং আটকিয়ে দিয়ে ডিম্ববাহী নালী পথকে বন্ধ করে দেয়া হয়, ফলে নালীপথের ধারাবাহিকতা বন্ধ হয়ে যায়। বাংলাদেশে এই পদ্ধতিতে কোথাও কোথাও টিউবেকটমি করা হয়।

টিউবেকটমি অপারেশনের সুবিধা

টিউবেকটমি অপারেশনের অসুবিধা

পুরুষদের স্থায়ী পদ্ধতি

ভ্যাসেকটমি/এনএসভি (NSV)

যেসব পুরুষের কমপক্ষে দুটি জীবিত সন্তান রয়েছে ও ছোট সন্তানের বয়স কমপক্ষে ১ বছর হয়েছে এবং ভবিষ্যতে নিশ্চিতভাবে আর কোন সন্তান নিতে চান না তাদের জন্য ভ্যাসেকটমি/এনএসভি একটি নিরাপদ ও কার্যকরী জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি।

ভ্যাসেকটমি/এনএসভি অপারেশন কিভাবে করা হয়

এ পদ্ধতিতে ছুরি বা সার্জিকেল ব্লেডের প্রয়োজন হয় না। সার্জিকেল ব্লেডের পরিবর্তে বিশেষভাবে প্রস্তুতকৃত সরু ও ধারালো ফরসেপের সাহায্যে অন্ডথলির মাঝ রেখা বরাবর মাত্র একটি ছিদ্রকরে উভয় পার্শ্বের শুক্রবাহী নালী বের করে এনে বেঁধে কেটে দেয়া হয়। ফলে কোন সেলাই লাগে না এবং রক্তপাতও হয় না। বর্তমানে বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বে এনএসভি পদ্ধতিতে ভ্যাসেকটমি করা হয়।

ভ্যাসেকটমি/এনএসভি অপারেশনের সুবিধা

ভ্যাসেকটমি/এনএসভি অপারেশনের অসুবিধা

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *