ডায়াবেটিস একটি বিপাক জনিত রোগ। আমাদের শরীরে ইনসুলিন নামের হরমোনের সম্পূর্ণ বা আপেক্ষিক ঘাটতির কারনে বিপাকজনিত গোলযোগ সৃষ্টি হয়ে রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ বৃদ্ধি পায় এবং এক সময় তা প্রস্রাবের সংগে বেরিয়ে আসে। এই সামগ্রিক অবস্থাকে ডায়াবেটিস বলে। ডায়াবেটিস ছোঁয়াচে বা সংক্রামক কোন রোগ নয়।
ডায়াবেটিস হয়েছে কিভাবে বুঝবেন
ডায়াবেটিস হলে সাধারণত: যেসব লক্ষন ও উপসর্গ গুলো দেখা দেয়:
- ঘন ঘন প্রস্রাব হওয়া
- খুব বেশী পিপাসা লাগা
- বেশী ক্ষুধা পাওয়া
- যথেষ্ঠ খাওয়া সত্ত্বেও ওজন কমে যাওয়া
- ক্লান্তি ও দুর্বলতা বোধ করা
- ক্ষত শুকাতে দেরী হওয়া
- খোশ-পাঁচড়া,ফোঁড়া প্রভৃতি চর্মরোগ দেখা দেওয়া
- চোখে কম দেখা
ডায়াবেটিসের প্রকারভেদ
ডায়াবেটিসের মূলত চারটি ধরন রয়েছে।
ক) ধরন ১ (টাইপ.১)- এই ধরনের রোগীদের শরীরে ইনসুলিন একেবারেই তৈরী হয় না। সাধারণতঃ ৩০ বৎসরের কম বয়সে (গড় বয়স ১০-২০ বৎসর) এ ধরনের ডায়াবেটিস দেখা যায়। সু্স্থ্য থাকার জন্য এ ধরনের রোগীকে ইনসুলিন নিতে হয়। এই ধরনের রোগীরা সাধারনত কৃষকায় হয়ে থাকেন।
খ) ধরন ২ (টাইপ.২)-এই শ্রেণীর রোগীর বয়স অধিকাংশ ক্ষেত্রে ত্রিশ বৎসরের উপরে হয়ে থাকে। তবে ত্রিশ বৎসরের নিচে এই ধরনের রোগীর সংখ্যা দিন দিন বেড়ে চলেছে। এই ধরনের রোগীদের শরীরে ইনসুলিন তৈরী হয় তবে তা প্রয়োজনের তুলনায় যথেষ্ঠ নয় অথবা শরীরে ইনসুলিনের কার্যক্ষমতা কমে যায়। অনেক সময় এই দুই ধরনের কারণ একই সাথে দেখা দিতে পারে। এই ধরনের রোগীরা ইনসুলিন নির্ভরশীল নন। অনেক ক্ষেত্রে খাদ্যাভাসের পরিবর্তন এবং নিয়িমিত ব্যয়ামের সাহায্যে এদের চিকিৎসা করা সম্ভব। এই ধরনের রোগীরা বেশীরভাগ ক্ষেত্রে স্থূলকায় হয়ে থাকেন।
গ) অন্যান্য নির্দিষ্ট কারণ ভিত্তিক শ্রেণী–
- জেনেটিক কারনে ইনসুলিন তৈরী কম হওয়া
- জেনেটিক কারনে ইনসুলিনের কার্যক্ষমতা কমে যাওয়া
- অগ্ন্যাশয়ের বিভিন্ন রোগ
- অন্যান্য হরমোনের আধিক্য
- ঔষধ ও রাসায়নিক দ্রব্যের সংস্পর্শ
- সংক্রামক ব্যধি
- অন্যান্য কোন প্রতিরোধ ক্ষমতার জটিলতা
এই ধরনের রোগী ক্ষীণকায় ও অপুষ্টির শিকার হয়ে থাকে এবং ইনসুলিন ছাড়া অনেক দিন বেঁচে থাকতে পারে। এই ধরনের রোগীর বয়স ৩০ বৎসরের নিচে হয়ে থাকে।
ঘ)গর্ভকালীন ডায়াবেটিস–অনেক সময় গর্ভবতী অবস্থায় প্রসূতিদের ডায়াবেটিস ধরা পড়ে। আবার প্রসবের পর ডায়াবেটিস থাকে না। এই প্রকারের জটিলতাকে গর্ভকালীন ডায়াবেটিস বলা হয়। গর্ভবতী মহিলাদের ডায়াবেটিস হলে গর্ভবতী,ভ্রুণ,প্রসূতি ও সদ্য-প্রসূত শিশু সকলের জন্যই বিপদজনক হতে পারে। বিপদ এড়ানোর জন্য গর্ভকালীন অবস্থায় ডায়াবেটিসের প্রয়োজনে ইনসুলিনের মাধ্যমে বিশেষভাবে নিয়ন্ত্রণে রাখা দরকার। এই ধরনের রোগীদের প্রসব হাসপাতালে করা প্রয়োজন।
কি কি পরীক্ষা নিরীক্ষার প্রয়োজন হতে পারে
- খালি পেটে রক্ত পরীক্ষা
- ভরা পেটে রক্ত পরীক্ষা
- প্রস্রাব পরীক্ষা
- কোলেস্টরল,থাইরয়েডের কার্যাবলী,যকৃত এবং কিডনী পরীক্ষা
ডায়াবেটিসের চিকিৎসা
ডায়াবেটিস সম্পূর্ণ সারানো বা নিরাময় করা যায় না। তবে আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থা গ্রহন করলে এ রোগকে খুব ভালভাবে নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। ডায়াবেটিস রোগ নিয়ন্ত্রণে থাকলে প্রায় স্বাভাবিক কর্মঠ জীবন যাপন করা যায়। এবং এই বিষয়ে ডাক্তারের পরামর্শ নেয়া প্রয়োজন।
ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে করণীয়
ক) নিয়ন্ত্রিত খাদ্য গ্রহণ -ডায়াবেটিস হলে খাদ্যের একটি নির্দিষ্ট নিয়ম মেনে চলতে হয়। খাদ্যের নিয়ম মেনে চলার প্রধান উদ্দেশ্য থাকে: ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখা, স্বাস্থ্য ভাল রাখা।
- আঁশবহুল খাবার ডাল, শাক (পালং, পুই, কচু, কলমি, লাল শাক, সবজি (ফুলকপি, বাধাকপি, লাউ, কাচা পেঁপে, চাল কুমড়া, ডাঁটা, চিচিঙ্গা, পটল, টমেটো, শশা), টক ফল (কচি ডাব, লেবু, আমড়া, কাল জাম, কামরাঙ্গা, জাম্বুরা, বাঙ্গি, কাচা আম, পেয়ারা, ইত্যাদি) ইচ্ছামতো খাওয়া যাবে।
- শর্করা জাতীয় খাদ্য, মিষ্টি ফল ও মিষ্টি সবজি পরিমানমতো খেতে হবে।
- উদ্ভিদ তেল, অর্থাৎ সয়াবিন তেল, সরিষার তেল ইত্যাদি এবং সব ধরনের মাছ খাওয়া অভ্যাস করতে হবে
- চিনি/গুঁড়-মিষ্টি জাতীয় খাবার, শরবত (কেক, পেস্তি, জ্যাম, জেলি, মিষ্টি, মিষ্টি বিস্কুট, সফট ড্রিক কোক, পেপসি, ট্যাং, ওভাল্টিন, হরলিক্স কনডেন্সড মিল্ক, আইস্ক্রিম ইত্যাদি) খাওয়া যাবেনা। প্রয়োজনে ডায়াবেটিক চিনি ও ডায়েট ড্রিংকস খাওয়া যাবে।
- ঘি, মাখন, চর্বি,ডালডা, মাংস, তেলে ভাঁজা খাবার, ফাস্ট ফুড ইত্যাদি কম খেতে হবে।
- অন্যান্য রোগে আক্রান্ত হলে অর্থাৎ অসু্স্থ অবস্থায় বিশেষ খাদ্য-ব্যবস্থা জেনে নিতে হবে।
খ) ব্যায়াম-রোগ নিয়ন্ত্রণের বিষয়ে ব্যায়াম বা শরীর চর্চার ভূমিকা খুব গুরুত্বপূর্ণ। ব্যায়াম করলে শরীর সু্স্থ থাকে,ইনসুলিনের কার্যকারিতা ও নি:সরনের পরিমাণ বেড়ে যায়, ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রনে থাকে। প্রতিদিন সকালে অথবা বিকালে অন্তত: ৩০-৪৫ মিনিট দ্রুত হাঁটতে হবে ।
গ) ঔষধ–সকল ডায়াবেটিক রোগীকেই খাদ্য,ব্যায়াম ও শৃঙ্খলা মেনে চলতে হবে। অনেক ডায়বেটিস রোগীর ক্ষেত্রে খাবার বড়ি অথবা ইনসুলিন ইনজেকশনের দরকার হতে পারে।
ঘ) শিক্ষা– ডায়াবেটিস আজীবনের রোগ। সঠিক ব্যবস্থা নিলে এই রোগকে সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। ব্যবস্থাগুলি রোগীকেই নিজ দায়িত্বে মেনে চলতে হবে। এ রোগের সুচিকিৎসার জন্য ডায়াবেটিস সর্ম্পকে রোগীর যেমন শিক্ষা প্রয়োজন, তেমনি রোগীর নিকট আত্মীয়দেরও এই রোগ সর্ম্পকে কিছু জ্ঞান থাকা দরকার।
কাদের ডায়াবেটিস হতে পারে?
যে কেউ যে কোন বয়সে যে কোন সময় ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হতে পারেন। তবে তিন শ্রেণীর লোকের ডায়াবেটিস হওয়ার সম্ভাবনা বেশী থাকে:
- যাদের বংশে, যেমন-বাবা-মা বা রক্ত সর্ম্পকিত নিকট আত্মীয়ের ডায়াবেটিস আছে
- যাদের ওজন অনেক বেশী
- যারা ব্যায়াম বা শারীরিক পরিশ্রমের কোন কাজ করেন না
- বহুদিন ধরে কর্টিসোল জাতীয় ঔষধ ব্যবহার করলে
অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস থেকে কি ধরনের বিপদ হতে পারে?
- পক্ষাঘাত
- স্নায়ুতন্ত্রের জটিলতা
- হুদরোগ
- পায়ে পচনশীল ক্ষত
- চক্ষুরোগ
- মুত্রাশয়ের রোগ, প্রস্রাবে আমিষ বের হওয়া, পরবর্তীতে কিডনীর কার্যক্ষমতা লোপ পাওয়া
- পাতলা পায়খানা
- যক্ষা
- মাড়ির প্রদাহ
- চুলকানি
- ফোঁড়া
- পাঁচড়া
- রোগের কারণে যৌন ক্ষমতা কমে যাওয়া
- মহিলাদের ক্ষেত্রে বেশী ওজনের শিশু, মৃত শিশুর জন্ম, অকালে সন্তান প্রসব, জন্মের পরই শিশুর মৃত্যু এবং নানা ধরনের জন্ম ত্রটি দেখা দিতে পারে
কিভাবে বুঝবেন আপনার ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে আছে?
উত্তর.ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে আছে কিনা বোঝার উপায় হচ্ছে রক্তের শর্করার (গ্লুকোজ) মাত্রা পরীক্ষা করে দেখা। যদি খালি পেটে রক্তের শর্করার (গ্লুকোজ) মাত্রা ৬.১ মিলি মোল/লিটার থাকে এবং খাওয়ার পর ৮.০ মিলি মোল/লিটার পর্যন্ত হয়, তবে ডায়াবেটিস খুব ভাল নিয়ন্ত্রণে আছে বলে মনে করতে হবে।
ডায়াবেটিস কি সারানো যায়?
উত্তর. ডায়াবেটিস রোগ সারে না । এ রোগ সারা জীবনের রোগ। তবে আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থা গ্রহন করলে এ রোগকে খুব ভালভাবে নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। ডায়াবেটিস রোগ নিয়ন্ত্রণে থাকলে প্রায় স্বাভাবিক কর্মঠ জীবন যাপন করা যায়।
যা মনে রাখতে হবে
- নিয়মিত ও পরিমাণ মতো সুষম খাবার খেতে হবে
- নিয়মিত ও পরিমাণমতো ব্যায়াম বা দৈহিক পরিশ্রম করতে হবে
- ডাক্তারের পরামর্শ ও ব্যবস্থাপত্র সুষ্ঠভাবে মেনে চলতে হবে
- শরীর পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে
- পায়ের বিশেষ যত্ন নিতে হবে
- নিয়মিত প্রস্রাব পরীক্ষা করতে হবে এবং ফলাফল প্রস্রাব পরীক্ষার বইতে লিখে রাখতে হবে
- চিনি, মিষ্টি, গুড়, মধুযুক্ত খাবার সম্পূর্ণ বাদ দিতে হবে
- ধূমপান করা যাবে না
- শারীরিক কোন অসুবিধা দেখা দিলে দেরী না করে ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে
- ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া কোন কারণেই ডায়াবেটিস রোগের চিকিৎসা বন্ধ রাখা যাবে না
- তাৎক্ষনিক রক্তে শর্করা পরিমাপক যন্ত্র দিয়ে নিজে নিজেই রক্তের শর্করা পরিমাপ করে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারলে সবচেয়ে ভাল
- রক্তে শর্করা পরিমাপক বিশেষ কাঠি দিয়েও তাৎক্ষনিকভাবে রক্তের শর্করা পরিমাপ করা যায়
সংকলনে-
ডাঃ তানভীর আহমদ সিদ্দিকী