এইডস এর সম্ভাব্য লক্ষণ ও প্রতিকার

শেয়ার করুন

সুচিপত্র

এইডস (AIDS) হচ্ছে এইচ.আই.ভি. (HIV) নামক ভাইরাসের কারণে সৃষ্ট এমন এক রোগ, যা মানুষের শরীরের রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা হ্রাস করে। এইডস (AIDS) এর পূর্ণরূপ হল Acquired Immune Deficiency Syndrome। যেহেতু এইডস শরীরের স্বাভাবিক রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে ক্রমান্বায়ে ধ্বংস করে, তাই এইডসে আক্রান্ত রোগী খুব সহজেই যে কোন সংক্রামক রোগে (নিউমোনিয়া, যক্ষ্মা, ডায়রিয়া ইত্যাদি) আক্রান্ত হতে পারেন, যা শেষ পর্যন্ত তার মৃত্যু ঘটাতে পারে। এইডস এর কোন প্রতিষেধক বা কার্যকর ওষুধ এখনও আবিষ্কার হয়নি।

মানবদেহে এইচআইভি প্রবেশ করার সাথে সাথেই শরীরে এইডস এর লক্ষণ দেখা যায় না। এইচআইভি ভাইরাস শরীরে প্রবেশের কতদিন পর একজন ব্যক্তির মধ্যে এইডস এর লক্ষণ দেখা যাবে তা নির্ভর করে ঐ ব্যক্তির শারীরিক অবস্থার উপর। এইচআইভি সংক্রমণের শুরু থেকে এইডস হওয়া পর্যন্ত সময়ের ব্যাপ্তি সাধারণত ৬ মাস থেকে বেশ কয়েক বৎসর এমনকি কোন কোন ক্ষেত্রে ৫ থেকে ১০ বৎসর পর্যন্ত হতে পারে। এই সময়কালে এইচআইভি সংক্রমিত একজন ব্যক্তি নিজের অজান্তেই অন্য একজন সুস্থ ব্যক্তির দেহে এইচআইভি ভাইরাস ছড়িয়ে দিতে পারেন।

এইডস একটি ভয়ানক ব্যাধি। যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টার অফ ডিসেস কন্ট্রোল এন্ড প্রিভেনশন বা সি ডি সি ১৯৮১ সালে প্রথম এই রোগ প্রথম সনাক্ত করে। পরবর্তীতে ১৯৮৪ সালে ফ্রান্স এবং যুক্তরাষ্ট্রের বিজ্ঞানীরা এই মহামারী রোগের ভাইরাস (HIV) শনাক্ত করেন।

এইচআইভি আক্রান্তের প্রাথমিক লক্ষন

কখনো কখনো এই ভাইরাসে আক্রান্ত হবার ৬ সপ্তাহ পরে কিছু অনির্দিষ্ট লক্ষন দেখা দিতে পারে যেমন- জ্বর, গলা ব্যাথা, মাথা ব্যথা ইত্যাদি। এইসব লক্ষন কোনরকম চিকিৎসা ছাড়াই আবার সেরেও যায়, সে কারণে রোগী এ ভাইরাস সম্পর্কে কোন ধারনা পায় না। HIV কোনরকম লক্ষন প্রকাশ ছাড়াই ৫ থেকে ১০ বছর পর্যন্ত মানুষের শরীরে নিরবে অবস্থান করতে পারে।

এইডস রোগের লক্ষন

  • শরীরের ওজন দ্রুত হ্রাস পাবে।
  • ২ মাসেরও বেশি সময় ধরে পাতলা পায়খানা।
  • ঘন ঘন জ্বর হবে অথবা রাতে শরীরে অতিরিক্ত ঘাম হবে।
  • শুকনা কাশি হওয়া।

এইডস এর সূনির্দিষ্ট কোন লক্ষণ নেই। আবার এইডস আক্রান্ত ব্যাক্তি অন্য কোন রোগে আক্রান্ত হলে সে রোগের লক্ষণ দেখা যাবে। কারো মধ্যে উপরের এক বা একাধিক লক্ষণ দেখা দিলেই নিশ্চিত হওয়া যাবে না যে তার এইডস হয়েছে। তবে, কোন ব্যক্তির এসব লক্ষণ দেখা দিলে অবশ্যই বিলম্ব না করে দ্রুত বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।

এইচআইভি/এইডস প্রতিরোধে করণীয়

এইচআইভি সংক্রমণ কিভাবে হয়, সে সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে এইডস প্রতিরোধ করতে হবে। এইডস প্রতিরোধে যেসব ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারেঃ

  • কোন কারণে রক্ত গ্রহণের প্রয়োজন হলে রক্তদাতার রক্তে এইচআইভি আছে কি না সেটা অবশ্যই পরীক্ষা করে নিতে হবে।
  • যৌনসঙ্গী নির্বাচনে সতর্ক হতে হবে এবং মিলনের আগে খোলাখুলি কথা বলে নিরাপত্তার ব্যপারে নিশ্চিত হতে হবে।
  • অনিরাপদ যৌনমিলনের সময় অবশ্যই কনডম ব্যবহার করতে হবে।
  • যেকোনো যৌনরোগে আক্রান্ত হলে দেরি না করে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
  • প্রতিবারই ইনজেকশনের নতুন সূঁচ ও সিরিঞ্জ ব্যবহার করতে হবে।
  • এইচআইভি/এইডস আক্রান্ত মায়ের ক্ষেত্রে, সন্তান গ্রহণ, গর্ভাবস্থা, প্রসব এবং সন্তানকে বুকের দুধ দেয়ার ক্ষেত্রে ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে।

যৌনরোগ এবং এইচআইভি’র সম্পর্ক

যৌনরোগ এবং এইচ আই ভির মধ্যে সম্পর্ক অত্যন্ত গভীর। যৌনরোগে আক্রান্ত কোন ব্যক্তির এইচআইভি দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা একজন সুস্থ্য মানুষের চেয়ে অনেকগুণ বেশি। এসটিডি (Sexually Transmitted Disease) এবং এসটিআই (Sexually Transmitted Infection) হচ্ছে এমন কিছু রোগ বা সংক্রমণ যা সাধারণত অনিরাপদ যৌনমিলনের মাধ্যমে বিস্তার লাভ করে। আবার কিছু কিছু যৌনরোগ যৌনমিলন ছাড়া অন্য উপয়েও সংক্রমিত হতে পারে। যৌনরোগসমূহ ভাইরাস অথবা ব্যকটেরিয়া ঘটিত হতে পারে, যেমন- গনোরিয়া, সিফিলিস, এইচআইভি, হেপাটাইটিস বি, জননেন্দ্রিয়ের চর্মরোগ, ফোঁড়া ইত্যাদি। যননাঙ্গ বা এর আশেপাশে ঘা বা চুলকানি হলে, প্রসাবের সময় ব্যথা ও জ্বালা করলে, যৌনাঙ্গ থেকে পুঁজ পড়লে ইত্যাদি ক্ষেত্রে অবশ্যই দ্রুত বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।

এইডস কিভাবে ছড়ায়

বাতাস, পানি, খাবার কিংবা স্পর্শের মাধ্যমে এইচআইভি ছড়ায় না। সাধারনত এইচআইভি মানবদেহের কয়েকটি নির্দিষ্ট তরল পদার্থের (রক্ত, বীর্য ও বুকের দুধ) মাধ্যমেই ছড়ায়। সুনির্দিষ্টভাবে নিম্নলিখিত কিছু উপায়ে এইচআইভি ছড়াতে পারেঃ

  • এইচ.আই.ভি. তে আক্রান্ত ব্যক্তির রক্ত গ্রহণ করলে অথবা তার ব্যবহৃত ইনজেকশনের সিরিঞ্জ বা সূঁচ ব্যবহার করলে।
  • এইচআইভি/এইডস আক্রান্ত রোগীর রক্ত সুস্থ্য ব্যক্তির দেহে পরিসঞ্চালন করলে।
  • আক্রান্ত ব্যাক্তি কতৃক ব্যবহৃত সুচ অথবা সিরিঞ্জ অন্য কোন ব্যাক্তি ব্যবহার করলে।
  • আক্রান্ত ব্যক্তির কোন অঙ্গ অন্য কোন সুস্থ্য ব্যক্তির দেহে প্রতিস্থাপন করলে।
  • এইচ.আই.ভি. তে আক্রান্ত গর্ভবতী মায়ের শিশুরও এইডস এ আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে, যা গর্ভধারণের শেষদিকে অথবা প্রসবের সময় হতে পারে। তবে জিডোভুডিন নামক ওষুধ ব্যবহার করে এই সম্ভাবনা কিছুটা কমানো যেতে পারে।
  • অনিরাপদ দৈহিক মিলনের ফলে অর্থাৎ এইচ.আই.ভি. তে আক্রান্ত কারো সাথে কনডম ব্যবহার না করে যৌন সম্পর্ক করলে।

এইচআইভি কোন কোন উপায়ে ছড়ায় না

  • বাতাস, পানি, খাবার এবং স্পর্শের মাধ্যমে এইচআইভি ছড়ায় না।
  • আক্রান্ত ব্যক্তির সাথে একই প্লেটে খাবার খেলে এইচআইভি ছড়ায় না।
  • আক্রান্ত ব্যক্তির সেবা করলে এইচআইভি ছড়ায় না।
  • একই বিছানা ব্যবহার কিংবা একই পোশাক পরিধান করলেও এইচআইভি ছড়ায় না।
  • আক্রান্ত ব্যক্তির হাঁচি, কাশি থেকে এইচআইভি ছড়ায় না।
  • একই পুকুরে গোসল করলে এইডস ছড়ায় না।
  • মশা কিংবা অন্য কোনো পোকা-মাকড়ের কামড়ের মাধ্যমেও এইডস ছড়ায় না।

এইচ.আই.ভি. সংক্রমণ ছোঁয়াচে নয়

শরীর থেকে নিঃসরিত অধিকাংশ তরলেই এইচ.আই.ভি. ভাইরাস থাকে। তবে স্নেহপদার্থের আবরণ থাকায় এইচ.আই.ভি. অত্যন্ত ভঙ্গুর। তাই এইচ.আই.ভি. ভাইরাস শরীরের বাইরে বেশীক্ষণ বেঁচে থাকতে পারে না। তাই সরাসরি রক্ত বা যৌন নিঃসরণ শরীরে প্রবেশ না করলে এইচ.আই.ভি. সংক্রমণের সম্ভাবনা নাই বললেই চলে। স্পর্শ, একত্রে খাওয়া এমনকি একই জামাকাপড় পরলেও এইচ.আই.ভি. সংক্রমনের কোন সম্ভাবনা নেই। আবার মশার কামড়েও এইচ.আই.ভি. ছড়ায় না। তাই, এইচ.আই.ভি. সংক্রামক বা ছোঁয়াচে নয়।

এইডস’এ আক্রান্ত ব্যাক্তির পরিচর্যা

এইডস যেহেতু একটি মরণব্যাধি আবার একজন এইডস আক্রান্ত ব্যক্তি অতি সহজেই অন্যকে সংক্রমিত করে না। তাই, এইডসে আক্রান্ত ব্যক্তিকে আমাদের সামজ থেকে যেন বিচ্ছিন্ন না করে তাকে স্বাভাবিক জীবন-যাপনে সাহায্য করতে হবে। যেমন-

  • অক্রান্ত হওয়ার সাথে সাথেই সে তার কর্মক্ষমতা হারিয়ে ফেলে না। তাই তাকে স্বাভাবিকভাবে কাজকর্ম করায় উৎসাহিত করতে হবে।
  • এইডস আক্রান্ত ব্যক্তির সাথে আন্তরিকতাপূর্ণ ও সৌহার্দ্যমুলক আচরণ করতে হবে।
  • তাদেরকে মানসিকভাবে হাসিখুশি রাখার চেষ্টা করতে হবে।
  • তাদের প্রতি ভাল ব্যবহার করতে হবে এবং যত্নবান হতে হবে।
  • এইচআইভি অক্রান্তদের তাদের দৈনন্দিন কাজকর্মে বঞ্চিত না করা।
  • প্রয়োজনীয় চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে।

এইডস রোগের চিকিৎসা

এইডসে আক্রান্ত ব্যক্তির মৃত্যু অনিবার্য এবং এর কোনো সঠিক চিকিৎসাও নেই। তবে কিছু কিছু ঔষধ আছে যা ARV (Anti Retroviral Drug) নামে পরিচিত, এগুলো এইচআইভি আক্রান্ত ব্যক্তিকে সাময়িকভাবে ভালো থাকতে সাহায্য করে। 

প্রথম গ্রুপ এর ঔষধের নাম Nucleoside reverse transcriptase inhibitors, যা HIV সংক্রমনকে কিছুটা বিলম্বিত করে। দ্বিতীয় গ্রুপ এর নাম Protease inhibitors যা HIV ভাইরাস replication এ বাধা দেয়। এদের যে কোন একটি গ্রুপ এর ঔষুধ একা শরীরে কার্যকর হয় না, তাই সম্বিলিতভাবে দুইগ্রুপের ঔষধ দেয়া হয়। যদিও এটি এইডস উপশম করেনা, তবে এইডস রোগীর মৃত্যু কিছুটা বিলম্বিত করতে পারে। এই চিকিৎসা অনেক ব্যয়বহুল।