ইউটিআই : কিডনি ও মূত্রনালির সংক্রমণ

শেয়ার করুন

সুচিপত্র

কিডনি ও মূত্রনালির রোগজীবাণুজনিত সংক্রমণকে ইউরিনারি ট্রাক্ট ইনফেকশন (ইউটিআই) বলে। কিডনি ও পেলভিসের ইনফেকশনকে ওপরের মূত্রনালির ইনফেকশন বা একিউট পাইলোনেফ্রাইটিস বলে। আর কিডনিতে স্থায়ীভাবে দাগ পড়ে গেলে তখন ক্রনিক পাইলোনেফ্রাইটিস হয়। নিম্নের মূত্রনালির ইনফেকশনকে সিস্টাইটিস বলে। এ ধরনের মূত্রনালির ইনফেকশন প্রতিরোধ করা যায়।

কাদের হয়?
পুরুষের তুলনায় নারীদের ইউটিআই হয় চার গুণ বেশি। সাধারণত ১৫ থেকে ৬০ বছরের নারীরাই এতে বেশি ভোগে, যার প্রকোপ ২০ ভাগ। গড়ে প্রায় ৫০ ভাগ নারী বিশেষ করে যৌন সক্রিয় বয়সে ইউরিনারি ট্রাক্ট ইনফেকশনের (ইউটিআই) উপসর্গে ভুগতে থাকে।

শৈশবকাল : মূত্রনালিতে জন্মগত বৈকল্য ইউরেথ্রার ভাল্ভ, ব্ল্যাডার নেক অবস্ট্রাকশন ইত্যাদির কারণে শৈশবের প্রথম দিকে এই রোগ ছেলেদের বেশি হয়। এ বয়সে উপসর্গহীন জীবাণু নিঃসরণ ঘটে, অথচ তারা উপসর্গ বোঝে না বা বলতে পারে না। তখন সচেতন না হলে পরবর্তী সময় ক্রনিক পায়লোনেফ্রাইটিসে রূপ নিয়ে কিডনির জটিল অসুখ হতে পারে।

স্কুলপড়ুয়া মেয়েরা : এক থেকে দুই শতাংশ স্কুলপড়ুয়া মেয়ের উপসর্গহীন জীবাণু নিঃসরণ ঘটে। তখন চিকিৎসা করা না হলে ভবিষ্যতে, বিশেষ করে বিয়ের পর এবং গর্ভাবস্থায় ক্রনিক পায়লোনেফ্রাইটিস হতে পারে। এ ছাড়া ভেসিকো ইউরেটারিক রিফ্লাক্সে ভোগার প্রবণতাও থাকে। বয়োবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে নারীদের মধ্যে এ রোগের প্রকোপ বেশি দেখা দেয়।

গর্ভাবস্থায় : প্রায় পাঁচ ভাগ গর্ভবতী নারী উপসর্গহীন নিঃসরণে ভোগে, যাদের ১৫ থেকে ৫০ ভাগের পাইলোনেফ্রাইটিসে ভোগার ঝুঁকি বেশি। গর্ভাবস্থায় ইউরিনারি ট্রাক্ট ইনফেকশন মা ও শিশুর ওপর হুমকি, যাতে প্রিম্যাচিউরড ডেলিভারি, নিউনেটাল ডেথ, স্টিলবার্থ, অ্যাবরশন ইত্যাদি বেশি হয়। এসব প্রসূতির সন্তানরা বুদ্ধিবৃত্তি এবং পেশিশক্তিতে দুর্বল হয়। গর্ভবতী মায়েদের উচ্চ রক্তচাপ ও প্রি-এক্লাকমটিক টক্সিমিয়া হওয়ার ঝুঁকি বেশি থাকে।

বয়স্ক পুরুষ : ৪০ বছরের পর পুরুষদের প্রস্টেটগ্ল্যান্ড বড় হয়ে প্রস্রাবে বাধার সৃষ্টি হয়, তখন বয়স্ক পুরুষদের এ রোগের মাত্রা বেড়ে যায়।

এ ছাড়া যেসব শিশুর ভেসিকো ইউরেটারিক রিফ্ল্যাক্স থাকে, যাদের মূত্রনালিতে অবস্ট্রাকশন থাকে তারা এবং স্নায়ুবিক বৈকল্যজনিত মূত্রথলির প্যারালাইসিস, বিশেষ করে মেরুদণ্ডে আঘাতপ্রাপ্ত রোগীরা এই সমস্যায় বেশি ভুগতে

পারে।

কারণ
ইউটিআই-এর অন্যতম প্রধান জীবাণু ইসকেরেসিয়া কোলাই (ইকোলাই)। হাসপাতালে ভর্তি রোগীদের মধ্যে স্ট্রেপটো ফিকালিস, প্রোটিয়াস, স্টেফ অরিয়স, ক্লেবসিলা এরোজেনস ও সিডোমোনাসজনিত ইউরিনারি ট্রাক্ট ইনফেকশনের (ইউটিআই) প্রকোপ ৮০-৯০ শতাংশ বেশি। আবার বারবার ইউটিআই হওয়ার পেছনে পেরিনিয়াল ও ইউরিনারি ব্লাডার রোগজীবাণুর সংযুক্তি দায়ী, যাতে জীবাণুর বৃদ্ধি এবং ঊর্ধ্ববাহী ইনফেকশনও হতে পারে।

রোগজীবাণু পেরিনিয়াম থেকে নারীদের মূত্রনালিতে (ইউরেথ্রা) দিয়ে ব্লাডারে প্রবেশ করে এবং সংক্রমণ শুরু হয়। যৌন সক্রিয় নারীদের ইউরেথ্রাল ইনজুরিই হলো প্রধান কারণ, যা কোনো রোগজীবাণু ওপর দিকে প্রবেশ করতে সাহায্য করে। ব্লাডার থেকে ভেসাইকো ইউরেটারিক রিফ্ল্যাক্সের ফলে জীবাণুর ওপর দিকে প্রবেশের কারণে কিডনির সংক্রমণ হয়। এ ধরনের সংক্রমণ বেশি হলেও রক্তবাহিত জীবাণু দ্বারাও কিডনির সংক্রমণ হয়। বিশেষ করে আগে থেকেই কিডনির অসুখ এবং মূত্রনালিতে বাধা বা অবস্ট্রাকশন থাকলে।

উপসর্গ
ইউরিনারি ট্রাক্ট ইনফেকশন বা ইউটিআই-এর বেশ কিছু উপসর্গ থাকে। যেমন—

প্রস্রাবে কষ্ট বা প্রস্রাব করার সময় জ্বালা, ঘন ঘন প্রস্রাব ইত্যাদি।

দুর্বলতা, খাওয়ায় অরুচি।

বারবার জ্বর হওয়া।

শিশুদের বিছানায় প্রস্রাব করা।

শিশুর ঠিকমতো বেড়ে না ওঠা।

পেটের পীড়া (অজীর্ণ, ডায়রিয়া প্রভৃতি)।

জটিলতা
ইউটিআইয়ের বিরক্তিকর দিক হলো, এর পুনরাগমন বা রিকারেন্স। যেসব নারীর ইউরিনারি ইনফেকশন হয়, তাদের ৫০ ভাগের প্রথম এক বছরের মধ্যে আবার ইনফেকশন হতে পারে। যখন একই জীবাণু দ্বারা সংক্রমণ হয়, তখন রিকারেন্সকে রিলাপ্স বলে।

রোগ নির্ণয়
উপসর্গ থাকলে এই রোগ নির্ণয় খুব সহজ, আবার ভুলও হতে পারে। কিছু রোগীর উপসর্গ ছাড়াই ইনফেকশনও থাকতে পারে। সুতরাং এ রোগ সঠিকভাবে নির্ণয়ের জন্য ল্যাবরেটরি পরীক্ষা-নিরীক্ষার প্রয়োজন রয়েছে। এর মধ্যে কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা হলো—

প্রস্রাবের শ্বেতকণিকা : প্রস্রাব পরীক্ষায় মাইক্রোস্কোপের নিচে পাঁচের বেশি পুঁজ সেল বিদ্যমান থাকলে, তা ইউরিনারি ট্রাক্ট ইনফেকশনের ইঙ্গিত দেয়। যেসব রোগীর প্রস্রাবের সঙ্গে পুঁজ সেল বের হয় অথচ সাধারণ কালচার করে কোনো রোগজীবাণু পাওয়া যায় না, তাদের বেলায় টিউবারকিউলোসিসের জীবাণু এবং ক্লেমাইডিয়া ট্রেকোমেটিসের অনুসন্ধান চালানো প্রয়োজন। এর সঠিক রোগ নির্ণয় জীবাণু কালচারের মাধ্যমে হয়।

ইউরিন কালচার : প্রস্রাবের স্রোতের মধ্যভাগ থেকে প্রস্রাব নিয়ে কালচার করা এবং রোগজীবাণু পরিমাপ করে ইউটিআই নির্ণয় করা যায়। সঠিক পদ্ধতিতে মিড স্ট্রিম ইউরিন সংগ্রহ করে দ্রুত ল্যাবরেটরিতে ট্রান্সফার করে কালচার করালে ভুল রিপোর্ট পাওয়ার আশঙ্কা থাকে না।

প্রতি মিলিমিটারে ইউরিন এক লাখ বা ততোধিক রোগজীবাণু পাওয়া গেলে তাকে সাফিশিয়েন্ট ইউরিন ইনফেকশন বলে। ইউটিআইকে স্থানীয়ভুক্ত করার উদ্দেশ্য হলো, ওপরে ট্রাক্ট ইনফেকশনকে পৃথকীকরণ করা। যাতে দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসা দ্বারা ক্ষয় রোধ করা যায়। জ্বর, কোমরে ব্যথা হলে ইউরেটার থেকে প্রস্রাবের স্যাম্পল সংগ্রহ করা হয়। এই পরীক্ষা অত্যন্ত সেনসিটিভ ও স্পেসিফিক। তবে এতে বিশেষ ধরনের যন্ত্রের সাহায্যে ইউরিন সংগ্রহ করা হয়। এটা শিশুদের ভেসিকো ইউরেটারিক রিফ্ল্যাক্সের বেলায় উপকারী নয়।

ফেয়ারি টেস্ট : এটি ব্লাডার ওয়াস আউট টেস্ট, যা একটা ক্যাথেটারের সাহায্যে স্টেরাইল নরমাল স্যালাইনের মাধ্যমে ব্লাডার পরিষ্কার করা হয়। এর শেষ অংশটুকু কালচারের জন্য সংগ্রহ করা হয়। এরপর ১০ মিলিগ্রাম ফ্রুসেমাইড ইনট্রাভেনাস ইনজেকশন দেওয়া হয় এবং ২০, ৩০ ও ৬০ মিনিট পর ইউরিন স্যাম্পল সংগ্রহ করে কালচার করা হয়। জিরো সময়ে স্যাম্পল জীবাণু কলোনি কাউন্ট থাকে ১ শতাংশের কম এবং পরে স্যাম্পলগুলোতে ১০ শতাংশের বেশি জীবাণু কলোনি কাউন্ট বাড়লে তবে ওপরের ট্রাক্ট ইনফেকশন নির্ণয় করা হবে।

অ্যান্টিবডি আবৃত জীবাণু দিয়ে পরীক্ষা : এই পরীক্ষার যৌক্তিকতা হলো, যখন জীবাণু কিডনিকে আক্রমণ করে, এর বিরুদ্ধে শরীরে অ্যান্টিবডি তৈরি হয়, সেটি রোগজীবাণুর সঙ্গে লেগে যায়। ফ্লোরেসেন্ট পদ্ধতি ব্যবহার করে একে শনাক্ত করা যায়।

সাধারণত ১ শতাংশ ফ্লোরেসেন্ট জীবাণুকে কাট অব পয়েন্ট হিসেবে ধরা হয়। তবে এই পরীক্ষায় ফলস পজিটিভ এবং নেগেটিভ রেজাল্ট আসে। নিয়মিত ক্লিনিক্যাল প্র্যাকটিসে এর ব্যবহার হয় না।

ওপরের ও নিচের ট্রাক্ট ইনফেকশনকে পৃথকীকরণ করার জন্য আরো বিভিন্ন টেস্ট ব্যবহার করা হয়—যেমন বিটা-২ মাইক্রোগ্লোবুলিন এক্সক্রিসান, ইউরিনারি লেকটিক ডি হাইড্রোজিনেস (এলডিএইচ) আইসো এনজাইম ৪, ৫ ও সিঙ্গল ডোজ অ্যান্টিমাইক্রোবিয়ার টেস্ট ইত্যাদি।

রেডিওলজিক মেথড : ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত ইন্ট্রাভেনাস ইউরোগ্রাম/(আইভিইউ) প্রায় কিডনিতে জখম নির্ণয়ে সাহায্য করে। অবস্ট্রাকটিভ পাইলোনেফ্রাইটিসের ১-৩ শতাংশ ক্ষেত্রে আইভিইউতে কোনো দোষ ধরা যায় না।

চিকিৎসা
সাধারণ ব্যবস্থা : প্রত্যেক ইউটিআইর রোগীদের উচিত বেশি পরিমাণ পানি পান এবং ঘন ঘন প্রস্রাব করা। প্রস্রাবের পিএইচ পরিবর্তন করার তেমন দরকার হয় না।

একুইট ইনফেকশন : সাম্প্রতিক অনেক গবেষণায় দেখা গেছে, এক ডোজ অ্যান্টিবায়োটিকে এ ধরনের ইনফেকশন সেরে যায়। নিচে কয়েকটি ওষুধের সিঙ্গেল ডোজ দেওয়া হলো—ট্রাইমিথপ্রিম সালফামিটোক্সিম ৪৮০/২৪০০ মিলি গ্রাম। কেফালোস্পেরিন ২ গ্রাম, এমোক্সিসিলিন ৩ গ্রাম। জেন্টোমাইসিস, কেনামাইসিস-৫০০ মিলিগ্রাম ইন্ট্রামাসকুলার।

ঘন ঘন ইনফেকশন হলে : বারবার হলে রিলাপস ও রিইনফেকশন হয়। রিলাপসে ইনফেকশনের জীবাণু থেকে যায়। ওষুধের প্রতি জীবাণুর রেসিস্ট্যান্স অথবা অপ্রতুল চিকিৎসার ফলে কয়েক দিনের মধ্যে একই জাতীয় এবং একই সিরোটাইপের জীবাণুর আবির্ভাব হয়।

অন্যদিকে সাধারণত নতুন জীবাণু দ্বারা সংগঠিত হয় এবং অনির্দিষ্ট সময় পরে হয়। রিলাপস এবং রিইনফেকশন দুটিই ওপরের এবং নিচের ইনফেকশনে হতে পারে। এ জন্য  অ্যান্টিবায়োটিক প্রয়োগ করে দুই সপ্তাহ চিকিৎসা করানো দরকার। তবে দীর্ঘদিন যাবৎ ৫০ মিলিগ্রাম নাইট্রোফুরানটয়েন বা ১০০ মিলিগ্রাম টাইমিথোপ্রিম রাতে সেবন করলে ভালো ফল পাওয়া যায় বা রিইনফেকশন প্রতিরোধ করা যায়।