আমাদের পেটের ভেতর প্যানক্রিয়াস বলে একটি অঙ্গ থাকে। প্যানক্রিয়াসকে বাংলায় বলে অগ্ন্যাশয়। সন্ধি বিচ্ছেদ করলে দাঁড়ায় অগ্নি+আশয়। বোঝাই যাচ্ছে, এটা একটা সাংঘাতিক অঙ্গ, যার ভেতর আগুন আছে। আগুনটা হলো অ্যানজাইম বা পাচক রস। খুব শক্তিশালী কিছু পাচকরস এর ভেতরে থাকে। এটি শর্করা, আমিষ ও স্নেহ তিন রকমের খাবারকেই হজম করে। সব মিলিয়ে প্রায় ২২ রকমের পাচক রস আছে। কোনো কারণে এই অগ্ন্যাশয়ে প্রদাহ হলে তাকে বলে প্যানক্রিয়াটাইটিস।
প্যানক্রিয়াসের প্রদাহ দুই রকমভাবে হতে পারে। একটি হঠাৎ প্রদাহ বা অ্যাকিউট প্যানক্রিয়াটাইটিস, আরেকটি হলো ধীরগতির প্রদাহ বা ক্রনিক প্যানক্রিয়াটাইটিস।
অগ্ন্যাশয়ের হঠাৎ প্রদাহ কেন হয়?
এ রোগের প্রধান কারণ পিত্তনালির পাথর। অগ্ন্যাশয়ের প্রদাহের মূল কারণটিই হলো অতিরিক্ত মদ্যপান। কোনো কারণে দেহে লিপিড কিংবা কোলেস্টেরলের মাত্রা বেড়ে গেলে বা দেহে ক্যালসিয়ামের মাত্রা বেশি হলে এ রোগ দেখা দেয়। অগ্ন্যাশয়ে আঘাত লাগলেও প্যানক্রিয়াটাইটিস হতে পারে। এ ছাড়া কিছু কিছু ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবে (যেমন : স্টেরয়েড), মাম্পসজাতীয় রোগের জটিলতা হিসেবে, কিছু কিছু অপারেশনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবে প্যানক্রিয়াটাইটিস হতে পারে। জিনগত কারণ অথবা একেবারে অজানা কারণেও এটা হতে পারে।
রোগের লক্ষণ
রোগীর প্রচণ্ড পেট ব্যথা হয়। ব্যথা সাধারণত পেটের ওপরের দিকের বাঁ পাশে হয়। ডান দিকে ও পেছনের দিকেও ছড়িয়ে পড়ে। পেট চেপে সেজদার ভঙ্গিতে বসলে রোগী আরাম পায়।
তীব্র ব্যথার সঙ্গে বমি হতে পারে। অনেক ক্ষেত্রেই রোগী অজ্ঞান হয়ে যায়। হঠাৎ প্রদাহে রোগী মারাও যেতে পারে। প্রদাহের কারণে পিত্তনালি সরু হয়ে গেলে জন্ডিস দেখা দিতে পারে।
জটিলতা
অগ্ন্যাশয়ের প্রদাহ থেকে অনেক জটিলতা হতে পারে। যেমন : অগ্ন্যাশয়ের ক্ষতিগ্রস্ত কোষে ঘা বা ফোঁড়া তৈরি হওয়া, শরীরে ক্যালসিয়ামের ঘাটতি দেখা দেওয়ার কারণে খিঁচুনি হওয়া, অগ্ন্যাশয়-সংলগ্ন অন্ত্রনালি সরু হয়ে যাওয়া ইত্যাদি। অগ্ন্যাশয় ক্ষতিগ্রস্ত হলে উৎপন্ন তরল পদার্থ জমে জমে এক ধরনের সিস্ট তৈরি করে। জটিলতা হিসেবে রোগীর ডায়াবেটিসও হতে পারে। শ্বাসতন্ত্র আক্রান্ত হয়ে শ্বাসকষ্ট শুরু হতে পারে। অন্যান্য অঙ্গের কার্যকারিতা নষ্ট হতে পারে। যেমন : কিডনি বিকল হওয়া, লিভার বিকল হওয়া ইত্যাদি। পিত্তনালি বন্ধ হয়ে গিয়ে জন্ডিস হতে পারে। ভালো হয়ে যাওয়ার পরও অনেক রোগী দীর্ঘমেয়াদি ধীরগতির প্রাদাহে আক্রান্ত হতে পারে। সঠিক সময়ে রোগনির্ণয় এবং চিকিৎসা শুরু না হলে রোগী মারা যেতে পারে।
পরীক্ষা-নিরীক্ষা
১) রক্তরসে অ্যামাইলেজ ও লাইপেজ অ্যানজাইম পরীক্ষা করে সাধারণত এই রোগ ধরা হয়।
২) মূত্রে অ্যামাইলেজের পরিমাণও দেখা হয়।
৩) এ ছাড়া রক্তের সার্বিক পরীক্ষা, রক্তে সুগারের মাত্রা, ক্যালসিয়ামের মাত্রা, রক্ত রসে লিভার অ্যানজাইমের উপস্থিতি, রক্ত রসে ক্রিয়েটিনিনের উপস্থিতি ইত্যাদি দেখে রোগ ও রোগীর সার্বিক অবস্থা সম্পর্কে ধারণা করা হয়।
৪) আলট্রাসনোগ্রাম ও সিটি স্ক্যান করলে অগ্ন্যাশয়ের গাঠনিক অবস্থা বোঝা যায়। এ ছাড়া রোগের অবস্থা অনুযায়ী আরো কিছু পরীক্ষা লাগতে পারে।
চিকিৎসা
প্রথমেই যে বিষয়টি মাথায় রাখতে হবে, সেটা হলো অগ্ন্যাশয়ের হঠাৎ প্রদাহ একটি জরুরি অবস্থা। রোগীকে দ্রুত চিকিৎসার আওতায় নিতে হবে। হাসপাতালে ভর্তি করে চিকিৎসা দিতে হবে। আইসিইউর ব্যবস্থা আছে এমন হাসপাতালে নেওয়াই শ্রেয়। কারণ, এ সময় রোগীর অরগ্যান ফেইলিউর, শ্বাসকষ্ট হতে পারে। সে ক্ষেত্রে আইসিইউ জরুরি। রোগীকে না খাইয়ে, শিরায় স্যালাইন দিয়ে, নাকে নল পরিয়ে অ্যান্টিবায়োটিক দিয়ে চিকিৎসা দিতে হয়। ব্যথার জন্য প্যাথেডিন দিতে হয়। এ ছাড়া রোগের কারণ বুঝে কিছু বিশেষ চিকিৎসা দিতে হয়। যেমন পিত্তে পাথরের জন্য এ রোগ হলে শল্যচিকিৎসার মাধ্যমে তা অপসারণ করতে হবে। মদ্যপানের জন্য এ রোগ হলে অবশ্যই তা ছাড়তে হবে।