1. বিসিজি (Bacillus Calmette-Guerin Vaccine (BCG)
বিসিজি টিকা বাচ্চার জন্মের পর থেকে ১৫ দিন সময়ের মধ্যে যে কোনও সময় দেওয়া যায়। এই টিকা টিউবারকুলোসিস মেনিনজাইটিস (Tuberculous Meningitis) বা বাচ্চাদের একরকম যক্ষ্মা রোগ থেকে রক্ষা করে। ইঞ্জেকশনের মাধ্যমে এই বিসিজি টিকা বাচ্চাকে দেওয়া হয়ে থাকে।আদর্শ বিসিজির ডোজে ১ মিলিলিটার টিকার তরলে ০.১ মিলিগ্রাম ওষুধ থাকে।বাচ্চাকে একটাই বিসিজি ডোজ দেওয়া হয়।
2. হেপাটাইটিস বি টিকা (Hepatitis B vaccine)
আমাদের শরীরে হেপাটাইটিস বি নামক ভাইরাসের আক্রমণ হলে, লিভার প্রচণ্ডভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। লিভার ক্যান্সার হতে পারে, লিভার কাজ করা বন্ধ করে দেয়, এমনকী মৃত্যুও হতে পারে। রোগীর অজান্তেই এই রোগ অন্যদের মধ্যেও সংক্রামিত হতে পারে। এই সব রোগের বিরুদ্ধে শিশুর প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানোর জন্য তিনটি ডোজে হেপাটাইটিস বি টিকা দেওয়া হয়। জন্মের এক-দু’দিনের মধ্যে প্রথম ডোজ, শিশুর বয়স এক মাস হলে দ্বিতীয় ডোজ এবং ৬ মাস হলে তৃতীয় বা শেষ ডোজটি দেওয়া হয়।
3. পোলিও টিকা (Oral Polio Vaccine (OPV)
এই টিকাটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং পোলিও রোগের হাত থেকে শিশুকে রক্ষা করে। পোলিও রোগের প্রকোপে শিশুর পা বিকৃত হয়ে যায় এবং সারাজীবনের জন্য শিশু প্যারালাইজড হয়ে যেতে পারে। এই পোলিও টিকা চারটি ডোজে শিশুকে দেওয়া হয়। প্রথম ডোজ জন্মের পর থেকে ২ মাসের মধ্যে, দ্বিতীয় ডোজ ৪ মাস বয়সে, তৃতীয় ডোজ ৬-১৮ মাসের মধ্যে এবং শেষ ডোজটি বুস্টার ডোজ হিসেবে দেওয়া হয় ৪-৬ বছর বয়সের মধ্যে। ইঞ্জেকশনের মাধ্যমে এই ডোজগুলি দেওয়া যায় আবার ওষুধের মতো খাইয়েও দেওয়া যায়।
4. ডিটিএপি/ডিটিপি (DTaP/DTP)
এই টিকাটি টিটেনাস (Tetanus), ডিপথেরিয়া(Diphtheria) ও হুপিং কাশি(whooping cough) –এর মতো রোগ প্রতিরোধ করার ক্ষমতা শরীরে গড়ে তোলে। বাচ্চার ১.৫ মাস, ২.৫ মাস ও ৩.৫ মাস বয়সে এই টিকাটি দেওয়া হয়ে থাকে। এরপর, ১.৫ বছর বয়সে DPT-র দ্বিতীয় ডোজ দেওয়া হয় এবং ৫ বছর বয়সে Double DT-র আর একটি ডোজ দেওয়া হয়। DTaP টিকাই বর্তমানে ব্যবহার করা হয়, কারণ এটায় শিশু ব্যথা পায় না এবং আগের থেকে নিরাপদ। এর আগে শিশুকে DTP টিকা দেওয়া হত, এই DTP টিকা শিশুর জন্য খুবই যন্ত্রণাদায়ক ছিল।
5. রোটাভাইরাস টিকা (Rotavirus Vaccine)
রোটা ভাইরাসের আক্রমণে শিশুর মারাত্মক ডিহাইড্রেশন ও ডায়রিয়া হতে পারে। শিশুকে এই রোটাভাইরাস টিকা ওষুধের মতো খাওয়ানো হয়ে থাকে। শিশুর জন্মের ৬-১৫ সপ্তাহের মধ্যে এই টিকার প্রথম ডোজ খাওয়ানো হয়। মোট তিনটি ডোজে এই টিকা শিশুকে দেওয়া হয়। শিশুর ২ মাস বয়সে একটি, ৪ মাস বয়সে একটি এবং ৬ মাস বয়সে একটি, মোট তিনটি ডোজ দেওয়া হয়।
শিশুর টিকা, প্রয়োজনীয় তথ্যসমূহ (Essential Vaccination Chart for Babies in Bangla)
6. এইচ আই বি টিকা (Haemophilus influenzae B (HiB) Vaccine)
এই টিকা নিলে শিশুর শরীর হেমোফিলাস ইনফ্লুয়েঞ্জা (Haemophilus Influenzae) নামক ব্যাকটেরিয়ার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে তুলতে পারে। এর আক্রমণে শিশুর ত্বক, গলা এবং মস্তিস্ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। মেনিনজাইটিস, এপিগ্লটিস এবং নিউমোনিয়ার মতো রোগ থেকে শিশুকে রক্ষা করে।এই টিকাটিও বাচ্চাকে তিনটি ডোজে দেওয়া হয়ে থাকে। বাচ্চার ২ মাস এবং ৪ মাস বয়সে যথাক্রমে প্রথম ও দ্বিতীয় ডোজ দেওয়া হয়। বাচ্চার বয়স ১৫ মাস হয়ে গেলে শেষ ডোজটি বুস্টার ডোজ হিসেবে দেওয়া হয়ে থাকে।
7. এম এম আর (Measles Mumps Rubella (MMR) Vaccine)
হাম বা মিসলস, মাম্পস এবং রুবেলার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে তোলে এই টিকা। এই টিকাটি তিনটি ডোজে শিশুকে দেওয়া হয়ে থাকে। প্রথম ডোজটি ৯ মাস বয়সে দেওয়া হয়।
8. পি সি ভি (Pneumococcal Conjugate Vaccine (PCV)
এই টিকা বাচ্চাদের নিউমোনিয়া রোগের হাত থেকে রক্ষা করে। শিশুর ২ মাস বয়সে প্রথম, ৪ মাস বয়সে দ্বিতীয়, ৬-১৮ মাসের মধ্যে তৃতীয় ডোজ দেওয়া হয়। ৪-৬ বছরের মধ্যে একটি বুস্টার ডোজ দেওয়া হয়।
9. ভ্যারিসেলা টিকা (Varicella Vaccine)
চিকেনপক্সের জন্য দায়ী ভাইরাসের বিরুদ্ধে শিশুর শরীরে প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে তোলে এই টিকা। প্রথম ডোজ দেওয়া হয় শিশুকে ১২-১৮ মাসের মধ্যে। এর পরের ডোজটি দেওয়া হয় প্রথম ডোজের তিন মাস পরে।
10. হেপাটাইটিস এ টিকা (Hepatitis A Vaccine)
লিভারজনিত সমস্যার হাত থেকে রক্ষা পেতে এই টিকা দেওয়া হয়। হেপাটাইটিস এ নামক ভাইরাসের আক্রমণের বিরুদ্ধে শিশুর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। দুটি ডোজে এই টিকা শিশু পেয়ে থাকে। শিশুর ১২-২৩ মাস বয়সে প্রথম ডোজ এবং তার ৬-১০ মাস পরে দ্বিতীয় ডোজ দেওয়া হয়।
11. টি সি ভি টিকা (Typhoid Conjugate Vaccine (TCV)
টাইফয়েড রোগের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য শরীরকে প্রস্তুত করে এই টিকা। এই টিকাও দুটি ডোজে দেওয়া হয়। শিশুর ৯-১২ মাসের মধ্যে প্রথম ডোজ দিয়ে দেওয়া উচিত।
কিছু বিষয় মাথায় রাখুন(Essential Vaccination Chart for Babies)
- বাচ্চা নিজের মায়ের কোলে সবথেকে নিরাপদ ও নিশ্চিন্ত বোধ করে। কিন্তু টিকার জন্য ইঞ্জেকশন নেওয়ার সময় যদি আপনি ওকে কোলে নিয়ে থাকেন, তা হলে ও আপনার মুখ দেখতে পাবে না। বাবা বা পরিবারের অন্য কাউকে সঙ্গে নিয়ে যান, বাচ্চাকে ওনার কোলে দিন। আপনি এমনভাবে বাচ্চাটির পাশে তার গায়ে হাত দিয়ে থাকুন, যেন বাচ্চা বুঝতে পারে আপনি তার পাশেই আছেন এবং ওর কোনও ক্ষতি হবে না। এতে বাচ্চা ভয় কম পাবে।
- টিকা নেওয়ার পরেই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ওকে বুকের দুধ খাওয়ান বা ও যদি ফর্মুলা খেতে শুরু করেছে তা হলে তাই দিন। তবে বাচ্চা খুব কাঁদলে একটু শান্ত করে নিয়ে তবেই খাওয়ান। না হলে গলায় আটকে যেতে পারে।
- টিকা নেওয়ার পর বাচ্চার জ্বর আসতে পারে, এতে ঘাবড়ে যাবেন না। প্রয়োজনে ডাক্তারের পরামর্শ নিন।
- ডাক্তারের সাথে কথা বলে বাচ্চার টিকাকরণের সময় এবং ঠিক কোন সময় কী টিকা দিতে হবে, সে বিষয়ে নিশ্চিত হয়ে নিন। টিকার পরে ডাক্তারের অনুমতি নিয়ে তবেই ওই জায়গায় ব্যথা কমানোর মলম লাগান। ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া নিজে নিজে ব্যথা কমানোর কোনও ওষুধ বাচ্চাকে দেবেন না।
- কোনও রকম কুসংস্কার দ্বারা প্রভাবিত হয়ে বাচ্চার স্বাস্থ্যের সাথে ঝুঁকি নেবেন না। এই সমস্ত টিকা আপনার সন্তানকে সারা জীবন নানা জটিল রোগের হাত থেকে রক্ষা করবে। নিজের মনে কোনও সন্দেহ বা দ্বন্দ্ব দেখা দিলে ডাক্তারের সাথে বিশদে আলোচনা করুন।