শিশুর নিউমোনিয়া প্রতিরোধযোগ্য

শেয়ার করুন

সুচিপত্র

সামান্য শীতেও ঠাণ্ডা লেগে সর্দি-কাশি, ব্রঙ্কিওলাইটিস, এমনকি নিউমোনিয়া হতে পারে। নিউমোনিয়া মৃদু বা হালকা থেকে জীবনহানিকরও হতে পারে। তবে এটি সহজে প্রতিরোধযোগ্য এবং চিকিৎসার মাধ্যমে নিরাময়যোগ্য একটি রোগ।

পাঁচ বছরের নিচের শিশুমৃত্যুর অন্যতম কারণ নিউমোনিয়া। সেভ দ্য চিলড্রেনের ২০১৪ সালে প্রকাশিত তথ্য থেকে জানা যায়, বাংলাদেশে প্রতিবছর প্রায় ১৭ হাজার শিশুর মৃত্যু হয় নিউমোনিয়ার কারণে, যা পাঁচ বছরের কম বয়সী ১৬ শতাংশ শিশুমৃত্যুর কারণ।

নিউমোনিয়া কী?
নিউমোনিয়া হলো ফুসফুসের এক ধরনের ইনফেকশন বা প্রদাহ। এটি ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস, ফাঙ্গাস অথবা পরজীবীর কারণে হতে পারে। এটি একটি জটিল সংক্রমণ, যা প্রাথমিকভাবে ফুসফুসের বায়ুথলি অ্যালভিওলিতে (ফুসফুসের মধ্যে থাকা আণুবীক্ষণিক ঝিল্লি, যা অক্সিজেন শোষণ করে) বেশ জ্বালাপোড়ার সৃষ্টি করে বা ক্ষতিগ্রস্ত করে। অনেক সময় এতে তরল অথবা পুঁজ জমে যায়। তখন কাশির সঙ্গে শ্লেষ্মা অথবা পুঁজ, উচ্চ তাপমাত্রার জ্বর, ঠাণ্ডা লাগা, শ্বাসকষ্ট ইত্যাদি হতে পারে। তবে সব সর্দি-কাশিই নিউমোনিয়া নয়।

লক্ষণ
কোনো শিশুর নিউমোনিয়া হয়েছে কি না—এটা বোঝা যাবে কিছু লক্ষণ দেখে। তবে কাশি, শ্বাসকষ্ট ও জ্বর—এই তিনটি হলো নিউমোনিয়ার প্রধান লক্ষণ। জ্বর থাকতে পারে ১০০-১০৪ ডিগ্রি ফারেনহাইট বা তারও বেশি। নিউমোনিয়ার মাত্রা একটু বেড়ে গেলে বুকের খাঁচা (পাঁজরের নিচের অংশ) দেবে যেতে পারে। তখন শিশুটি দ্রুত শ্বাস নেয়। দুই মাসের কম বয়সী শিশুদের মিনিটে ৬০ বার বা তার চেয়ে বেশি শ্বাস নিতে দেখা যায়। দুই মাস থেকে ১২ মাস বয়সী নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত শিশু মিনিটে ৫০ বার বা তার চেয়ে বেশি শ্বাস নেয় এবং এক বছরের বড় শিশু ৪০ বার বা তার চেয়ে বেশিবার শ্বাস নেয়।

এ ছাড়া নিঃশ্বাসের সময় বুকে ব্যথা, ঘাম, চুপচাপ থাকা, খাবারে অরুচি, ক্ষুধামান্দ্য, পেট ব্যথা ইত্যাদি লক্ষণও থাকতে পারে। এমনকি শ্বাস-প্রশ্বাসের সঙ্গে খিঁচুনিও হতে পারে।

পরীক্ষা
প্রথমে রোগের লক্ষণগুলো দেখে বোঝা যাবে শিশুটি নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়েছে কি না। এরূপ লক্ষণ থাকলে অভিভাবকদের উচিত শিশুটিকে চিকিৎসকের পরামর্শে সঠিক চিকিৎসা গ্রহণ করা।

রক্ত পরীক্ষা ও বুকের এক্স-রে করলে বোঝা যাবে তার নিউমোনিয়া হয়েছে কি না। যদি দেখা যায় চিকিৎসায় তেমন উন্নতি হচ্ছে না, তখন কফ বা থুতু পরীক্ষা, রক্তে অক্সিজেনের মাত্রা নির্ণয় ইত্যাদি পরীক্ষা করলে নিশ্চিত হওয়া যায়।

নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে আরো অ্যাডভান্স লেভেলে চলে গেলে শিশুটিকে হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে পালস অক্সিমেটরি যন্ত্রের মাধ্যমে রক্তে অক্সিজেনের মাত্রা দেখা হয়। আউটডোরে রোগীকে অনেক সময় রক্তে অক্সিজেনের মাত্রার অনুপাত দেখে ভর্তি বা পরবর্তী চিকিৎসা দেওয়া হয়।

ঝুঁকি বেশি যাদের

প্রি-ম্যাচিউর বা স্বল্প ওজনের নবজাতক।

পুষ্টিহীন শিশু

ঘরের মধ্যে ধোয়া (ইনডোর হাউস পলিউশন)।

পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের বেশি হয়।

শালদুধ, এমনকি পূর্ণ দুই বছর বুকের দুধ পান করে না যেসব শিশু।

যাদের ইমিউনিটি সিস্টেম দুর্বল বা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম।

ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা ও আবদ্ধ ঘরে বসবাস যাদের।

পরোক্ষ ধূমপায়ী শিশু।

অন্য শারীরিক সমস্যা থাকলে বা মারাত্মক রোগে আক্রান্ত হলে, বিশেষ করে এইচআইভি, হাম, কিডনির রোগ ইত্যাদিতে আক্রান্ত শিশু। হামের সময় অথবা হাম থেকে সুস্থ হয়ে ওঠার পরও অনেক সময় জটিল ধরনের নিউমোনিয়া হয় শিশুদের।

চিকিৎসা
নিউমোনিয়া হয়েছে এমন মনে হলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে, বিশেষ করে শিশুটি বুকের দুধ বা খাওয়াদাওয়া ছেড়ে দিলে, খিঁচুনি হলে তাকে দ্রুত হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে চিকিৎসা দেওয়া উচিত। এর চিকিৎসা ও করণীয় হতে পারে—

গাইডলাইন অনুযায়ী সঠিক অ্যান্টিবায়োটিক প্রয়োগ।

সর্দি-কাশির জন্য লেবুর শরবত, অল্প গরম পানি, হালকা লিকারের চা, তুলশী/বাসক পাতার রস, মধু পান।

জ্বর থাকলে জ্বর কমানোর ওষুধ প্রয়োগ।

রক্তে অক্সিজেনের মাত্রা কম থাকলে মাস্কের মাধ্যমে অক্সিজেন দেওয়া।

প্রয়োজনে আইভি স্যালাইনও দিতে হতে পারে।

অনেক সময় রোগটি এমন মাত্রায় চলে যায়, তখন সি প্যাপ (কনটিনিউয়াস পজিটিভ এয়ারওয়ে প্রেসার) মেশিনে তোলার প্রয়োজন হয়।

গুরুতর পর্যায়ে ভেন্টিলেশন লাগতে পারে।

প্রতিরোধে করণীয়
নিউমোনিয়া একটি প্রতিরোধযোগ্য রোগ। আগেভাগে সতর্ক হয়ে কিছু পদক্ষেপ নিলে নিউমোনিয়ার মতো জটিল অসুখ থেকে শিশুদের রক্ষা করা যায়। এর জন্য কিছু করণীয় বা পরামর্শ হলো—

জন্মের পর শালদুধ ও পূর্ণ দুই বছর বুকের দুধ পান নিশ্চিত করা।

সব সময় শিশুর সঠিক যত্ন নেওয়া।

পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা, বিশেষ করে সাবান-পানি দিয়ে হাত ধোয়ার অভ্যাস করা।

শীতকালে শীত উপযোগী হালকা ও নরম গরম কাপড় ব্যবহার করা।

সহনীয় গরম পানিতে গোসল করানো।

বেশি মানুষের সংস্পর্শ এড়িয়ে চলা।

অসুস্থ লোক, বিশেষ করে হাঁচি-কাশিতে আক্রান্ত লোকের সামনে শিশুদের যেতে না দেওয়া।

সুস্থ শিশুকে সর্দি-কাশি, ব্রঙ্কিওলাইটিস, নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত শিশুর কাছে যেতে না দেওয়া।

আবদ্ধ ঘরে বসবাস না করা।

শিশুর সামনে বড়দের হাঁচি-কাশি না দেওয়া বা মুখে রুমাল বা কাপড় ব্যবহার করা।

শিশুকে কোলে নেওয়ার আগে হাত ধোয়া।

নাক পরিষ্কার রাখা।

ব্যবহূত টিস্যু ডাস্টবিন বা গর্তে ফেলা।

চুলার ধোঁয়া, মশার কয়েল ও সিগারেটের ধোঁয়া থেকে দূরে রাখা।

সুষম ও পুষ্টিকর খাবার দেওয়া, ভিটামিন ‘এ’ ও ‘ডি’ গ্রহণ।

ইমিউন সিস্টেম শক্তিশালী করতে পর্যাপ্ত ঘুম, নিয়মিত ব্যায়াম ও স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস গড়ে তোলা।

শিশু জন্মের পর ইপিআই শিডিউলের সব ভ্যাকসিন দেওয়া, বিশেষ করে বিসিজি, পিসিভি (নিউমোকক্কাল কনজোগেইট ভ্যাক্সিন), হিব (হিমোফাইলাস ইনফ্লুয়েনজি টাইপ বি ব্যাকটেরিয়া) ভ্যাকসিন বা টিকা নেওয়া।

অসুস্থ হলে দ্রুত হাসপাতালে নেওয়া বা চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া।